ব্যবস্থাপনা কাকে বলে বা কী?
ব্যবস্থাপনা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনা করে থাকে। ব্যবস্থাপনা মূলত যেসকল কাজ করে তা হচ্ছে:
- পরিকল্পনা
- সংগঠন
- কর্মীসংস্থান
- নির্দেশনা
- প্রেষণা
- সমন্বয়
ব্যবস্থাপনার ইংরেজি শব্দ Management। ব্যবস্থাপনার সজ্ঞা অনেকেই এই ম্যানেজমনেট শব্দকে বিশ্লেষণ করে দিয়ে থাকে। তারা বলে থাকে Management হলো Manage + Men + Tactfully বা মানুষকে কৌশলে পরিচালনা করাই ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা।
ব্যবস্থাপনার জনক কে?
ব্যবস্থাপনার জনক কে? এই প্রশ্নের উত্তর দুইভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। একটি হলো বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক কে? এবং অন্যটি আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক কে?
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক কে?
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক বলা হয় এফ. ডব্লিউ টেইলরকে (Frederick Winslow Taylor)। তিনি ১৮৫৬ সালের ২০ মার্চ জন্মগ্রহন করেন এবং ১৯১৫ সালের ২১ মার্চ মারা যান। তিনি একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক ক?
আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক বলা হয় হেনরি ফেওল (Henry Fayol)-কে। তিনি একজন মাইন ইঞ্জিনিয়ার। ২৯ জুলাই ১৮৪১ থেজে ১৯ নভেম্বর ১৯২৫ পর্যন্ত তার জীবনকাল।
ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি আলোচনা কর
ব্যবস্থাপনার মূল কার্যাবলি মূলত কয়টি তা নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানো কষ্টকর। তবে ব্যবস্থাপনার ৫টি এবং ৭টি কার্যাবলী বহুল প্রচলিত। আমরা এখানে ৭টি পড়ব এবং এরপর ৫টির ক্ষেত্রে কোন দুটিকে বাদ দেয়া হবে তা বলে দেব।
ব্যবস্থাপনার ৭ কার্যাবলি:
- পরিকল্পনা বা Planning
- সংগঠন বা Organization
- কর্মীসংস্থান বা Staffing
- নির্দেশনা বা Direction
- প্রেষণা বা Motivation
- সমন্বয় সাধন বা Coordination
- নিয়ন্ত্রণ বা Controlling
১. পরিকল্পনা (Planning):
পরিকল্পনা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক কাজ, যা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডগুলো নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এটি একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যৎ কর্মধারা নির্ধারণ, সম্পদ বরাদ্দ, এবং লক্ষ্য পূরণের জন্য কৌশল তৈরি করার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রফেসর নিউম্যানের মতে পরিকল্পনা হলো "Deciding in advance what is to be done."
পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হল লক্ষ্য নির্ধারণ। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যগুলো হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী বা স্বল্পমেয়াদী এবং সাধারণত সুনির্দিষ্ট, মাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, বাস্তবমুখী এবং সময়বদ্ধ (SMART) হওয়া উচিত। লক্ষ্য নির্ধারণের পর বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। এর জন্য বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদান যাচাই করা হয়, যার মধ্যে SWOT বিশ্লেষণ (Strengths, Weaknesses, Opportunities, Threats) অন্তর্ভুক্ত।
পরবর্তী ধাপে বিভিন্ন বিকল্প কৌশল প্রণয়ন করা হয় এবং এই কৌশলগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়। সবচেয়ে কার্যকর কৌশলটি নির্বাচন করার পর পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করা হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দ এবং কর্মধারা নির্ধারণ করা হয়। এই পর্যায়ে দায়িত্ব বণ্টন, সময়সূচি প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে নির্ধারিত কর্মধারা অনুযায়ী কাজ শুরু হয় এবং এর অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রয়োজনবোধে পরিকল্পনার মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়। সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফলভাবে অর্জন করতে পারে।
২. সংগঠন (Organizing)
সংগঠন হলো লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও কার্যাবলী সমন্বয় করার প্রক্রিয়া। এটি একটি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে কাজ ভাগ করে দেওয়া, দায়িত্ব প্রদান করা এবং কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানটি তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পদ ও কর্মীদের কার্যকরভাবে নিয়োজিত করা হয়, যা প্রতিষ্ঠানকে সংগঠিত এবং দক্ষতার সাথে পরিচালিত করতে সহায়তা করে।
৩. কর্মীসংস্থান (Staffing)
কর্মীসংস্থান ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাংশন যা প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ, নির্বাচন, প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তার মানবসম্পদ প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে এবং সেই অনুযায়ী কর্মী সংগ্রহ করে। কর্মীসংস্থানের প্রথম ধাপ হল জনবল পরিকল্পনা, যেখানে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কতজন কর্মী এবং কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়। এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, আবেদনপত্র সংগ্রহ এবং প্রার্থী বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা উন্নত করা হয়, যাতে তারা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারে। কর্মীসংস্থানের মাধ্যমে সঠিক কর্মী নিয়োগ এবং তাদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানকে সফলতা অর্জনে সহায়তা করে।
৪. নির্দেশনা (Direction)
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিমিত্তে কর্মীদের ফলপ্রসূ আদেশ-নির্দেশ প্রদান করাই নির্দেশনা। এটি ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক কাজ এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে এটি মূল চালিকাশক্তি। কর্মীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনই নির্দেশনার কাজ।
৫. প্রেষণা (Motivation)
শুধু নির্দেশনা দিয়েই থেমে গেলে হবে না। কর্মীদেরকে কাজ করানোর জন্য তাদেরকে যথাযথ প্রেষণা বা মোটিভেশনও দিতে হবে। এতে করে কর্মীদের ভেতর কাজ করার প্রতি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়।
৬. সমন্বয় সাধন (Coordination)
সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন প্রচেষ্টা চালানো হয়ে থাকে যাতে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উপায় উপকরণ ও কার্যসমূহকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায়। এতে করে লক্ষ্য অর্জন সহজতর হয়।
৭. নিয়ন্ত্রণ (Controlling)
ব্যবস্থাপনার মৌলিক কার্যাবলির শেষ কাজটি হলো নিয়ন্ত্রণ। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকমতো পরিচালনার উদ্দেশ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য কী কী?
ব্যবস্থাপনার ৮টি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। এই ৮টি বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. চলমান প্রক্রিয়া (Continuous Process)
ব্যবস্থাপনা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা নিয়মিতভাবে সম্পাদিত হয়। এটি কোনো এককালীন কাজ নয় বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া যা প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চালাতে থাকে। প্রতিদিনের কার্যক্রম, সমস্যা সমাধান এবং উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে।
২. লক্ষ্য অর্জনের উপায় (Means to Achieve Objectives)
ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হল প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা। এটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, কৌশল এবং সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণের উপায় নির্ধারণ করে। কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কার্যক্রমকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
৩. সামাজিক প্রক্রিয়া (Social Process)
ব্যবস্থাপনা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী একত্রে কাজ করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। এই প্রক্রিয়ায় ম্যানেজারদের সাথে কর্মীদের আন্তঃসম্পর্ক, সহযোগিতা এবং সমন্বয়মূলক কাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
৪. কাজ আদায়ের কৌশল (Techniques of Getting Things Done)
ব্যবস্থাপনা এমন কার্যাবলি যা অন্যদের দ্বারা কাজ আদায়ের কৌশল হিসবে স্বীকৃত। এখানে পরিকল্পনা, সংগঠন, দিক নির্দেশনা, সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। কার্যকর ব্যবস্থাপনা কর্মীদের প্রেরণা দেয়, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করে।
৫. জ্ঞানের পৃথক শাখা (Distinct Field of Knowledge)
ব্যবস্থাপনা একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানের শাখা যা বিভিন্ন তত্ত্ব, নীতি ও কৌশল দ্বারা গঠিত। এটি একটি পেশাগত ক্ষেত্র যা বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অধ্যয়ন করা হয়। ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব ও কৌশলগুলি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার জন্য ভালোভাবে আগে তা শিখতে হয়।
৬. বিজ্ঞান ও কলা (Science and Art)
ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান এবং কলার সমন্বয়। এটি বিজ্ঞান কারণ এটি সুসংহত তত্ত্ব ও নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং প্রমাণিত তথ্যের উপর নির্ভর করে। এটি কলা বা আর্টস কারণ ব্যবস্থাপনা প্রয়োগের সময় সৃজনশীলতা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। ম্যানেজারদের প্রতিদিনের কাজকর্মে উভয় দিকেই দক্ষ হতে হয়।
৭. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার (Efficient Use of Resources)
ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার। এটি মানবসম্পদ, অর্থ, সময়, এবং অন্যান্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে। ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান তার সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে এবং অপচয় এড়িয়ে চলে, যা প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৮. সার্বজনীনতা (Universality)
ব্যবস্থাপনা একটি সর্বজনীন কার্যাবলি, যা সকল প্রকার প্রতিষ্ঠানে (বাণিজ্যিক, অ-বাণিজ্যিক, সরকারি, বেসরকারি) এবং সকল স্তরে প্রযোজ্য। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি, দেশ এবং শিল্পের মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব ও কৌশলগুলি বিভিন্ন পরিবেশে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়।