[স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নামক বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে পরীক্ষায় আসে "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরনার্থীদের সম্পর্কে আলোচনা কর।" প্রশ্নটি। আজকের লেখাটি সেই প্রশ্নের উত্তর হিসেবেই লেখা হয়েছে।]
১৯৭১ সালের পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, যা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল, একটি মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার এবং গণহত্যার ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
এই বিশাল শরণার্থীদের নিয়ে খানিক আলোচনা করা হবে এই লেখায়। তার আগে যদি কেউ শরণার্থী কাকে বলে না জানেন তাহলে সংক্ষেপে বুঝে নিন "রোহিঙ্গারা বর্তমানে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে রয়েছে।"
১৯৭১ সালের শরণার্থী শিবির, ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল |
শরণার্থী স্রোত ও সংখ্যা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর হামলার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, এবং বিহার প্রভৃতি রাজ্যে শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়।
শরণার্থীদের জীবনযাত্রা ও অবস্থা
শরণার্থীদের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ ছিল। তাদের বেশিরভাগই সবকিছু হারিয়ে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা স্বাভাবিকভাবেই সেখানে খাবার, পানি, এবং চিকিৎসা সেবার অভাবে ভুগছিল। শরণার্থী শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব, জনস্বাস্থ্য সমস্যা এবং অসুস্থতা ব্যাপক থাকা খুবই স্বাভাবিক। দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যমতে,
তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশি শরণার্থী জুন-জুলাই মাসের কলেরার মহামারিসহ অন্যান্য রোগব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করেছে। এই সংখ্যার মধ্যে এপ্রিল-মে মাসে শরণার্থীদের পথযাত্রায় এবং ক্লান্তি ও পুষ্টি এবং অন্যান্য ব্যাধিতে মৃত্যুসংখ্যা হিসাব করা হয়নি। সব সংখ্যা হিসাব করা হলে শরণার্থীশিবিরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আরও কয়েক লাখ বেশি হতে পারে বলে আমরা অনুমান করি।
- দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
শরণার্থীদের সহায়তা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ভারতের সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী, খাদ্য, এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন ইউনিসেফ, রেড ক্রস, এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা শরণার্থীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা শরণার্থীদের ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ এবং বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে। শরণার্থীদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে সহায়ক হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের ভূমিকা
শরণার্থীরা শুধু ভুক্তভোগী নয়, তারা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিত করার কাজ চলত। শরণার্থীরা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ, খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করত বলে জানা যায়। অনেক শরণার্থী নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল পরবর্তীতে।
শরণার্থীদের ফেরত আনা ও পুনর্বাসন
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর শরণার্থীরা দেশে ফিরতে শুরু করে। ফেরত আসার পর তাদের পুনর্বাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তাদের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা, এবং সামাজিক পুনর্বাসন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া ছিল। বাংলাদেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহায়তা প্রদান করে।
শরণার্থীদের স্মৃতিচারণ ও ইতিহাসে তাদের স্থান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শরণার্থীদের অবদান অসীম। তাদের ত্যাগ ও কষ্টের গল্পগুলো আজও স্মরণীয়। শরণার্থীরা শুধু একটি মানবিক বিপর্যয়ের শিকার নয়, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের সংগ্রাম, সাহস, এবং সহনশীলতার কাহিনী বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের নিয়ে অনেক গ্রন্থ, প্রবন্ধ, এবং গবেষণা করা হয়েছে, যা তাদের অবদান ও অভিজ্ঞতাকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছে। তাদের স্মরণে বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
১৯৭১ সালের শরণার্থীদের নিয়ে আরও জানতে পড়ুন:
- ভারতে পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীর পরিসংখ্যান (উইকিপিডিয়া)
- বই: শরণার্থীর জবানবন্দি ১৯৭১, লেখক: পপি দেবী থাপা
- শরণার্থী শিবিরের তালিকা
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের অবস্থা, তাদের কষ্ট, সংগ্রাম, এবং অবদান এক বিশাল অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের অসীম সাহসিকতা এবং ত্যাগের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। শরণার্থীদের সেই দিনগুলোর স্মৃতি আজও প্রেরণা জোগায় এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের অবদানকে সম্মান জানায়।
[ইতিহাসের কোনো তথ্যে আমাদের পক্ষ থেকে ভুল থেকে থাকলে তা শুধরে দেয়ার অনুরোধ থাকলো।]