১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ লিখ

১৯৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চল ব্রিটিশদের অধীনে যেতে থাকে। ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনের পর ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। তখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান এবং ভারত নামের দুটি দেশকে স্বাধীনতা দিয়ে যায়। এসময় বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ।

১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

স্বাধীনতার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির একটি বড় কারণ এই সংবিধান প্রনয়ণ করতে না পারা। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান তার প্রথম সংবিধান পায়। এই সংবিধানের খড়সা প্রণীত হয় ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে এবং তা গণপরিষদে গৃহীত হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি। ২৩ মার্চ ১৯৫৬ থেকে এই সংবিধান কার্যকর হয়। এর মাত্র ২ বছরের মাথায় ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে এই সংবিধান বাতিল করা হয়।

১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিলের সংবাদ
প্রথম সংবিধান বাতিলের সংবাদ; সোর্স: Medium Blog

এই সংবিধানের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে। সেসব নিয়েই আজকের এই লেখা।

১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা

পাকিস্তানের প্রথম এই সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এদেশকে Islamic Republic of Pakistan হিসেবে সংবিধানে পরিচিত করানো হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরু হয় আল্লাহর নামে। একই সাথে এখানে রাষ্ট্রপতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হবেন ঠিক করা হয়।

২. অন্যতম বৃহৎ সংবিধান

১০৫ পৃষ্ঠার এই সংবিধান পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সংবিধান। এতে ১০৫ পৃষ্ঠায় মোট ১টি প্রস্তাবনা, ১৩টি পার্ট এবং ২৩৪টি বিধি ও ৬টি তালিকা ছিল।

৩. গণতন্ত্র

পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি হিসেবে বেঁছে নেয়া হয় গণতন্ত্রকে। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানে গণতন্ত্রান্তীক প্রক্রিয়ায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো থাকে।

৪. লিখিত সংবিধান

এই সংবিধানটি একটি লিখিত সংবিধান ছিল। ফলে বিভিন্ন বিষয়ের জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা দূরীভূত হয়েছিল।

৫. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান

পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান যা বর্তমানে মূল পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে বাংলাদেশ। এই দুটি অংশের মাঝে ভৌগলিক সীমান্তে কোনো সংযোগ ছিল না। দুই পাকিস্তানেরই অধিকাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর চাওয়া অনুযায়ী ইসলাম ও সনাতন- এই দুই ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারত ও পাকিস্তানকে আলাদা করা হয় এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশী মুসলিম নেতারাও এর পক্ষে ছিল এবং অনেক আগেই এমন দাবি জানিয়ে তারা লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল। 

পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বা United States। এখানকার দুটি দেশের মধ্যে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সংবিধানের আলোকে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের ব্যবস্থা হয়।

৬. সহজে পরিবর্তনীয় না

পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান বা ১৯৫৬ সালের সংবিধানের একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এটি সহজে পরির্তনীয় না। বরং দুষ্পরিবর্তনীয়। এর কোনো ধারা বা উপধারার পরিবর্তন করতে চাইলে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রথমে ওই সংশোধনীয় বিল উত্থাপন করা হতো। পরবর্তীতে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেলে তা পাস হবে বলে সংবিধানে উল্লেখ ছিল।

৭. সংসদ এবং এক-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা

পাকিস্তানের নতুন সংবিধান কেন্দ্র ও প্রদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যেখানে বলা হয় আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শাসন ক্ষমতা ধারণ করবে। এককক্ষবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে ৩০০ সদস্য থাকবে, এর মধ্যে ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং ১৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবেন। প্রাদেশিক আইনসভাও এককক্ষবিশিষ্ট হবে, যার সদস্য সংখ্যা ৩০০, এবং মহিলাদের জন্য ১০টি আসন সংরক্ষিত থাকবে।

৮. মৌলিক অধিকার

নাগরিকদের মৌলিক অধিকার উল্লেখ করা হয় পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে বা ভঙ্গ হলে আদালতের মাধ্যমে সুবিচার লাভের সুযোগ থাকে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে।

৯. স্বায়ত্তশাসন

পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান নামক দুটি প্রদেশ নিয়ে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান গঠিত। এই দুটি প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়। 

১০. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

সংবিধান মেনে চলা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। এজন্য একটি সুপ্রিম কোর্ট ও প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে হাইকোর্ট গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া হয়।

১১. রাষ্ট্রভাষা

পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের ভাষা উর্দু এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। এই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তান প্রথমে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়। এর প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান তথা ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ প্রথম সংবিধানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল দুটি। উর্দু এবং বাংলা।

১২. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইসলামে সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেদেরও স্বার্থরক্ষার নীতি অবলম্বন করা হয়। পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিক তার অধিকার লাভ করবে বলা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৯ বছর পর প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করলেও তা অনেকের মতে সফল ছিল, অনেকের মতে ছিল ব্যর্থ। দুই বছরের মাথায় এই সংবিধানকে বাতিল করে দেয় সেনা শাসন। তবে প্রথম সংবিধান হিসেবে এই সংবিধানটি স্বয়ংসম্পূর্ণই ছিল বলা যায়।

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺