Palestine Flag We support Palestine — Standing for justice, freedom, and human rights.

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব - অভিষেক দত্ত

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব - অভিষেক দত্ত

ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স বা সোজা ভাষায় নিউটনিয়ান মেকানিক্সে ভর, সময় ও দৈর্ঘ্য স্থির। এগুলো চেঞ্জ হয় না, যা আছে তাই থাকে। কিন্তু এই ধারণার কিছু সমস্যা দেখা যায়। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে দেখা গেলো, নিউটনিয়ান মেকানিক্সের সূত্রগুলো বৃহৎ পরিসরে তেমন একটা ভালো ফলাফল দিতে পারেনা। যেমন: কোনো বস্তু যখন আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে যায়, তখন বাইরের দুনিয়ার সাপেক্ষে তার সময় ধীরে চলে, দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়, ভর বেড়ে যায়।

নিউটনিয়ান মেকানিক্স ব্যবহার করে কখনোই এইসব জিনিসের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এছাড়াও নিউটনিয়ান মেকানিক্সে আলো ধ্রুব বেগে চলে না। কাজেই নিউটনিয়ান মেকানিক্সের কোনো সূত্রই আলোর বেগের উপর নির্ভরশীল না। কিন্তু জেমস্ কালর্ক ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্বানুসারে, আলোর বেগ মাধ্যমের ভেদনযোগ্যতা এবং ব্যাপ্তিযোগ্যতার উপর নির্ভর করে (বর্তমানে এগুলোকে অনেকেই যথাক্রমে ইলেক্ট্রিক কন্সটেন্ট আর ম্যাগনেটিক কন্সটেন্ট নামে চিনে)। যেহেতু কোনো মাধ্যমের ভেদনযোগ্যতা এবং ব্যাপ্তিযোগ্যতা ধ্রুব, কাজেই আলোর বেগও ধ্রুব (শূন্য মাধ্যমে সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার)। এই ধারণা ব্যবহার করে একজন ব্যক্তি ১৯০৫ সালে মহাবিশ্ব সম্পর্কে দুটি সত্য তুলে ধরেন।

সময়টা সাল ১৯০৫। সুইজারল্যান্ডের প্যাটেন্ট অফিসে কেরানী হিসেবে চাকুরীরত একজন ব্যক্তি একটি নয়, দুটি নয়. পরপর চার চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত করেছেন। বলছিলাম বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইনের কথা। এদের মধ্যে একটা জন্ম দেয় ফোটনের, আরেকটায় ছিলো পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ, আরেকটায় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (যেটাকে সবাই স্পেশাল রিলেটিভিটি নামে চিনে), আর সবার শেষেরটায় ছিলো পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণের ব্যাখ্যা:  E = mc2

১৯০৪ সালে বিজ্ঞানী হেন্ডরিক লরেঞ্জ আলোর বেগ ধ্রুব ধরে লরেঞ্জের রূপান্তর প্রকাশ করেন। তবে তিনি এই রূপান্তরের প্রতিপাদন করেছেন ঠিকই, কিন্তু এর ফিজিক্যাল মিনিং তিনি দিতে পারেননি। এই জিনিসের প্রকৃত ব্যাখ্যা দিতে সামনে আসেন আইনস্টাইন ও তাঁর স্পেশাল থিওরী অব রিলেটিভিটি।

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে একটা ঘটনা দেখে আসি। আমরা সবাই জানি, সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে, আর পশ্চিম দিকে ডুবে। অর্থ্যাৎ, পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। এখন পূর্ব দিক থেকে আসা কোনো আলোর বেগ যদি মাপতে যাই, তাহলে আলোর বেগের সাথে পৃথিবীর ঘোরার বেগ যোগ হবে। তার মানে, আলোর বেগ তিন লক্ষ কিলোমিটার থেকে বাড়বে। আবার উল্টা কাজ করলে, পশ্চিম দিক থেকে কোনো আলোর আসলে আলোর বেগ থেকে পৃথিবীর ঘোরার বেগ বিয়োগ হবে। এখানে আলোর বেগ কমে যাবে। এই জিনিস ঠিক কিনা তা যাচাই করতে বিজ্ঞানীরা মাপলেন। দেখলেন, যেইভাবেই আলোর বেগ হিসাব করা হোক না কেন, আলোর বেগ একটুও কমলো না, একটুও বাড়লো না। এইযে আলোর বেগ সবসময় ধ্রুব থাকে, এই ঘটনার ব্যাখ্যাই মূলত রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা।

স্পেশাল রিলেটিভিটিতে দুইটি স্বীকার্য রয়েছে। স্বীকার্যগুলো হলো -

  1. পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রসমূহ সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে একই থাকবে।
  2. আলোর বেগ সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে একই থাকবে। (অর্থ্যাৎ, আলোর গতিবেগ ধ্রুব।)

প্রথম স্বীকার্যটা দ্বিতীয়টার তুলনায় সরল। আমি যদি স্থির থাকি এবং আমার সামনে দিয়ে একটা ট্রেন যদি অতিক্রম করে, তাহলে আমার সাপেক্ষে ট্রেন গতিশীল এবং ট্রেনের সাপেক্ষে আমি গতিশীল। অর্থ্যাৎ ট্রেনের ভেতর যদি কোনো মানুষ থাকে, তাহলে তার মনে হবে সে স্থির আমি গতিশীল। এই বিষয়টিই বলা হয়েছে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের প্রথম স্বীকার্যে। এখন দ্বিতীয় স্বীকার্যটা নিয়ে একটু কথা বলা দরকার।

রিলেটিভিটি বোঝার জন্য আমাদেরকে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। ধরে নিলাম, আমার সামনে দিয়ে একটি ট্রেন যাচ্ছে, যার বেগ সেকেন্ডে দুই লক্ষ কিলোমিটার। এখন ট্রেনের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ সামনের দিকে এক হাজার কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে একটা বল নিক্ষেপ করল। এখন আমার কাছে বলটির বেগ মনে হবে সেকেন্ডে (দুই লক্ষ + এক হাজার) কিলোমিটার বা, দুই লক্ষ এক হাজার কিলোমিটার/সেকেন্ড। তাই না? কিন্তু যদি বলের পরিবর্তে ট্রেনের উপরের মানুষটি টর্চলাইট থেকে সামনের দিকে আলো ফেলে তাহলে আমার কাছে আলোর বেগ (দুই লক্ষ + তিন লক্ষ) = পাঁচ লক্ষ কিলোমিটার/সেকেন্ড হওয়ার কথা। রাইট? না! আলোর বেগ তিন লক্ষ কিলোমিটার/সেকেন্ড ই থাকবে। এক চুলও এদিক সেদিক হবে না। অর্থ্যাৎ, আলোর বেগ অপরিবর্তনীয় থাকবে। আলোর বেগ ধ্রুব। আলোর এই ধ্রুব বেগ বজায় রাখার জন্য সময় নিজে ধীরে চলে। এটিই আসলে সময় দীর্ঘায়ন (টাইম ডায়ালেশন)। বর্তমানের সবচেয়ে সূক্ষ্ম সময় পরিমাপের যন্ত্র হচ্ছে অ্যাটমিক ক্লক। অ্যাটমিক ক্লকের সাহায্যে পরীক্ষা করে জানা যায়, গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে সময় ধীর হয়। এর থেকে বোঝা যায়, নিউটনিয়ান ফিজিক্সে যেই সময়কে পরম বা স্থির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময় আসলে আপেক্ষিক। একেক জনের জন্য সময় একেক ভাবে চলে, কারো জন্য দ্রুত বা কারো জন্য ধীরে। শুধু সময়-ই নয়, দৈর্ঘ্য এবং ভরও আপেক্ষিক জিনিস। এই ক্ষেত্রে, স্থির প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর ভর প্রসারিত হয় ও দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়। ভর ও দৈর্ঘ্যের বিষয়টিও অনেকটা সময়ের মতোই।

এখন অবশ্যই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, যদি আমি তিন লক্ষ কিলোমিটার পাড়ি দিতে চাই এক সেকেন্ডে। এটা কী সম্ভব? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ অবশ্যই। কারণ, আমি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগের যত কাছাকাছি যাবো, রাস্তা ততই আমার জন্য ছোট হবে (দৈর্ঘ্য সংকোচন), সময়ও কমবে (সময় দীর্ঘায়ন)। কাজেই আমি যদি আলোর বেগের অনেক কাছাকাছি গতিতে চলি, আমি দেখবো ওই তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরের জায়গা, আমার বাড়ির পাশে চলে এসেছে। মাত্র তিন কিলো দূরে। আমার জন্য রাস্তা ছোট, আবার রাস্তার সাপেক্ষে আমি। কিন্তু, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কাছে রাস্তার দৈর্ঘ্য এক মিটারও কমবে না। যা আছে তাই থাকবে, বরং আমি তার কাছে ছোট হয়ে যাবো। এমনকি মজার বিষয় হলো, আমাদের কাছে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে আট মিনিট বিশ সেকেন্ডের মতো সময় লাগে। কিন্তু, আলোর কণা ফোটনের কাছে এই পথ অতিক্রম করতে কোনো সময়ই লাগে না। অন্যভাবে বললে, আমাদের জন্য সূর্য থেকে পৃথিবীর দুরত্ব পনেরো কোটি কিলোমিটার হলেও, ফোটনের জন্য এই দুরত্ব শূন্য! কী? মজা না?

এইযে, আলোর বেগে না চলার বিষয়টা, বিজ্ঞানীদের অনেক ভাবিয়েছে। আপেক্ষিকতার সমীকরণগুলো কোনো বস্তুর আলোর বেগে চলা সমর্থন করে না। আবার ভরহীন বস্তু (রেস্ট মাস) যেমন: আলোর কণা ফোটন কিন্তু ঠিকই আলোর গতিতেই চলে। এইযে, ভরহীন বস্তু আলোর গতিতে চলে, ভরযুক্ত বস্তু কোনো ভাবেই আলোর গতিতে চলতে পারবে না, সর্বোচ্চ আলোর বেগের কাছাকাছি গতি অর্জন করতে পারবে, এইটা জানার জন্য আমাদেকে ভরের দুনিয়া থেকে একবার ঘুরে আসতে হবে।

১৯৬৪ সালে, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস্ বস্তুর ভর অর্জনের বিষয় নিয়ে একটি ফিল্ডের কথা উল্লেখ করেন। পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে হিগস্ ফিল্ড নামক একটি অদৃশ্য ফিল্ড বিদ্যমান যা কিনা কোনো কণায় ভরের জন্ম দেয়। হিগস্ ফিল্ডই সেই জিনিস যা কোনো বস্তুকে আলোর বেগ অর্জন করতে বাধা দেয়। সর্বোচ্চ আলোর বেগের অনেক কাছাকাছি বেগ অর্জন করা সম্ভব হবে। কত কাছাকাছি? এর কোনো নিদির্ষ্ট সীমা নেই। যত কাছে যাওয়া যায়, ততই দৈর্ঘ্য কমবে। হিগস্ ফিল্ডের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার হিগস্ ফিল্ডের উদ্দীপনার থেকে তৈরী কণা হিগস্ বোসন সনাক্ত করে। যার মাধ্যমে হিগস্ ফিল্ডের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। এই হিগস্ ফিল্ডের সাথে যেই মৌলিক কণিকাগুলো বেশি ইন্টারেকশন করে তাদের ভর ততই বাড়ে। আলোর কণা ফোটন কোনো ইন্টারেকশান করে না বিধায় এর স্থির ভর শূন্য!

আচ্ছা বুঝলাম না হয় ভরযুক্ত কণা সর্বোচ্চ আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলতে পারে আর ভরবিহীন কণা আলোর বেগে চলে। কিন্তু কেউ যদি কখনো আলোর বেগের বেশি বেগে চলতো তখন? এই আলোর বেগের বেশি গতিতে চলা কোনো কণা আবিষ্কার হয়নি। হয়তো এইরকম কোনো কণার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। যদি কোনো কণা আলোর বেগের বেশি বেগে চলে, তবে তার ভর আর বাস্তব থাকবে না। কাল্পনিক ভর হয়ে যাবে। সময় উল্টা দিকে চলবে। সবকিছুর দৈর্ঘ্য ঠিক যেন দর্পনের প্রতিবিম্বের মতো উল্টা হয়ে যাবে। এই রকম একটা হাইপোথেটিক্যাল কণা আছে (কেবলই ধরে নেয়া হয়েছে)। এই কণার নাম ট্যাকিয়ন, যার অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। ট্যাকিয়নের ভর কাল্পনিক। যদি কোনো বস্তুকে আমি টেবিলের উপর থেকে নিচে পড়তে দেখি, ট্যাকিয়ন একই ঘটনা উল্টা দেখবে, মানে বস্তু নিচ থেকে উপরে উঠবে, যা অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতি - কার্যকরণ নীতিকে লঙ্ঘন করে।

অনেক কিছুইতো দেখলাম। ম্যাক্সওয়েলকে দেখলাম, লরেঞ্জ দেখলাম, দৈর্ঘ্য নিয়ে ভাবলাম, সময় নিয়ে কথা হলো, ভরের দুনিয়ায় পাড়ি জমালাম। এখন যদি এমন হয়, যমজ দুই ভাইয়ের মধ্য়ে একজন পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অন্যজন ছোটোখাটো রকেটে করে মহাশূন্যে আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে পৃথিবী ছেড়ে যায়, এরপর রকেটটি যদি ঘুরে (ইউ টার্ন) একদিন পর আবার পৃথিবীত আসে, তাহলে যমজ দুই ভাইয়ের বয়স কী একই হবে? (ভাবো, ভাবো! বাঁচতে হলে ভাবতে হবে)

লেখাটি পাঠিয়েছে: অভিষেক দত্ত

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺