নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ব্রিটিশদের অধীনে ছিল ১৯০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এই উপমহাদেশের মানুষেরা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে চান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বাঙালি, ভারতীয়, পাকিস্তানীরা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে যায়। সৈয়দ আহমদ, মীর নিসার আলী, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, সুভাশচন্দ্র বোসসহ অনেকেই বিভিন্ন ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। সেই পথযাত্রার শেষদিকে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার মূখ্য মন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমির দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন যা ইতিহাসের পাতায় লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত।
লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
১৭৫৭ সালে পলাশীর পর থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত হতে থাকে এই উপমহাদেশের জনগণ। লম্বা সময় ধরে সকলে মিলে মিশে এই আন্দোলন করা হলেও বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে কিছু কোন্দলের সৃষ্টি হয়। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন নামে একটি আইন পাশ করে। তবে এই আইন সে সময়ের জনপ্রিয় দুই দল তথা মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস তা মেনে নিতে পারে না। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
১৯৩৫ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ১১টি প্রদেশের মধ্যে ৭টিতে কংগ্রেস বিজয়ী হয়। বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশে বিজয়ী হয় মুসলিম লীগ। নিয়মানুযায়ী সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠনের কথা থাকলেও কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করে মুসলীম লীগকে বাদ দিয়ে। জওহর লাল নেহরুর এমন সিদ্ধান্ত এবং সে সময়ের এক বা একাধিক বক্তব্যের রেশ করে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে আবার।
কংগ্রেসের এমন মনোভাব থেকে মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে সামনে আসেন মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ। ১৯৩৯ সালে তিনি মুসলিম লীগকে পুনর্গঠিত করে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্র নীতি তুলে ধরেন যা ইতিহাসে দ্বিজাতি তত্ত্ব নামে পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি সম্বলিত প্রস্তাব পেশ করেন যা "লাহোর প্রস্তাব" নামে পরিচিত।
লাহোর প্রস্তাবে এমন বলা হয় যে,
Resolved that it is the considered view of this session of the All Indian Muslim league that the area in which the Muslims are numerically in a majority as in the North-western and Eastern zones of India should be grouped to constitute ‘’Independent states’’ in which constituent units shall be autonomous and sovereign’’
লাহোর প্রস্তাব
লাহোর প্রস্তাবে কিছু দাবি রাখা হয়, যেমন:- ভৌগলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে পৃথক অঞ্চল বলে গণ্য করা।
- উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের সমস্ত অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সমন্বয়ে একাধিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন করা এবং এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্বশাসিত।
- ভারতে ও নতুনভাবে গঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা।
- দেশের যেকোনো ভবিষ্যত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পণায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহন করা।
লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল
দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং লাহোর প্রস্তাব মূলত একই দাবির ভিন্ন সংস্করণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশরা সমস্ত পৃথিবী থেকে তাদের উপনিবেশ তুলে নিচ্ছিলো, তখন তারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও তুলে নেয়। তখন স্বাধীনতা দেয়ার ক্ষেত্রে এর উপর ভিত্তি করেই মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান নামে দুটি দেশ গঠন করে দিয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল।
এছাড়াও লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমেই এদেশের মুসলিমদের মধ্যে আবার ঐক্য সৃষ্টির একটি রাস্তা তৈরি হয় এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। যদিও সেসময় ভারতীয় হিন্দু নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। কিছু মুসলিম নেতারাও এর পক্ষ নেয়নি বলে ইতিহাস বলে, যদিও সংখ্যাটা নগণ্য।
[ইতিহাসের কোনো তথ্যে ভুল চোখে পড়লে আমাদেরকে জানানোর অনুরোধ থাকলো।]
আরও পড়ুন: