ইউক্রেনের ইতিহাস: পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান অধ্যায় | পর্ব ৪

ইউক্রেনের ইতিহাসের তৃতীয় পর্ব ‘গ্যালিসিয়া–ভলিনিয়া–মঙ্গোল’ শেষ করেছিলাম ইউক্রেনের নিজ ভূমির শেষ শাসক বলেস্লোর (Boleslaw of Mazowia) অধ্যায়ের সমাপ্তির ঘটনার মধ্য দিয়ে। বলেস্লোকে যেসকল দোষে দোষী সাব্যস্ত করে হত্যা করা হয়, সেসবের মধ্যে অন্যতম একটি দোষ ছিলো অর্থোডক্স মতবাদ থেকে ক্যাথলিক মতবাদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া। বলেস্লোর মৃত্যুর মাত্র ৯ দিন পরই পোলিশ রাজা ক্যাসিমির দ্যা গ্রেট (Casimir the Great) গ্যালিসিয়া গমন করে। এরপর একটা পর্যায়ে গ্যালিসিয়ার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। অর্থোডক্স-ক্যাথলিক যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বলেস্লোকে হত্যা করা হয়, সেই ধর্মীয় মতবাদ কেন্দ্রিক এক লড়াই ওই অঞ্চলে স্থায়ী হয় আরও ৬০০ বছর। এ ঘটনাসহ লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড কীভাবে ইউক্রেন দখল করে, কীভাবে ওই অঞ্চলে তারা তাদের শাসন পরিচালনা করে সেসব নিয়েই ইউক্রেনের ইতিহাসের আজকের পর্ব।

History Of Ukraine
Photo by Olga Subach on Unsplash

ইউক্রেন সুবিশাল সময় পর্যন্ত ইউরোপের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল ছিলো। নিপার নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিয়েভের ব্যবসায়িক গুরুত্ব ছিলো সেসময় অনেক বেশি। এই নিপার নদীকে ব্যবহার করে পৌঁছানো যেত বাল্টিক থেকে বাইজাইন্টাইন পর্যন্ত। এতসব গুরুত্ব বহন করতো বলেই একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিলো কিয়েভান রুশ। কিন্তু একাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই এক্ষেত্রে কিয়েভের গুরুত্ব কমে যেতে থাকে যখন ইতালি এশিয়া মাইনর, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের অনেক অঞ্চলে কিয়েভ বা নিপার নদীকে পাশ কাটিয়ে বাণিজ্য শুরু করে। ইউক্রেনের পুরো অঞ্চলেরই গুরুত্ব কমে যেতে থাকে সেসময় থেকে যার ষোল আনা পূর্ণ করে ১৩৪০ সালে বলেস্লোর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। একে একে ব্যবসায়ীরাও এই অঞ্চল ছেড়ে যেতে শুরু করে। গ্যালিসিয়া-ভলিনিয়া পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক- সব দিক থেকেই ইউক্রেন এক প্রকার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এরপরও ইউক্রেনকে নিজেদের মতো করে ছেড়ে দেয়নি প্রতিবেশী দেশগুলো। দখলের চেষ্টা চলেছে শুরু থেকেই। ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে বলেস্লোর মৃত্যুর পর থেকেই লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড নেমে পড়ে ইউক্রেন দখলের লক্ষ্যে।

গুরুত্বহীন হয়ে শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকা এই ইউক্রেন দখলের ক্ষেত্রে প্রথম সফল হয় লিথুয়ানিয়ানরা। বলেস্লোর মৃত্যুর বছরেই (১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ) লিথুয়ানিয়ার অ্যালগিরাডাস ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে এবং ঘোষোণা দেয় “All Rus’ simply must belong to the Lithuanians” । ১৩৫০ এর দশকেও নিপার নদীর আশেপাশে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তৃত করতে থাকে এবং সবশেষে ১৩৬২ সালে কিয়েভ পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেয়। পরের বছরই মঙ্গোলদের গোল্ডেন হর্ডকে (Golden Horde) পরাজিত করে পলিডিয়াতেও ঢুকে পড়ার মাধ্যমে লিথুয়ানিয়ানরা হয়ে যায় ইউরোপের সবথেকে বড় রাজনৈতিক সত্ত্বা।

লিথুয়ানিয়ানদের এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে প্রিন্স মিনডোগাস (Prince Mindaugas) এর ভূমিকা অনেক বেশি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে জার্মানদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তিনি নিজেদের টিকে থাকার লক্ষ্যে লিথুয়ানিয়ানের আদিম এবং যুদ্ধবাজ উপজাতিদের একসাথে সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। এসময়ে লিথুয়ানিয়ানরা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করে। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্র্যান্ড প্রিন্স গেডিমিনাস (Gediminas) এর নেতৃত্বে তারা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তার ছেলে অ্যালগিরাডাসের নেতৃত্বে ইউক্রেন দখলে নিয়ে নেয় লিথুয়ানিয়ানরা।

লিথুয়ানিয়ানরা কিয়েভ দখলের পর নিজেদের ধর্ম, ভাষা কিংবা সংস্কৃতি কোনোকিছুই কিয়েভবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়নি। কিয়েভে তাদের নীতি হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য যে কথাটি পাওয়া যায় তা হলো, “We do not change the old, nor do we bring the new” । তাদের এই নীতির কারণে ইউক্রেনীয়রা মঙ্গোলদের তুলনায় লিথুয়ানিয়ানদেরকে নিজেদের কাছের মানুষ মনে করতো। কিয়েভান রুশের ঐতিহ্য লিথুয়ানিয়ানরা বাঁচিয়ে রেখেছিলো। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, লিথুয়ানিয়ানদের অধীনে থাকা কিয়েভ প্রকৃতপক্ষে কিয়েভান রুশেরই একটি নব্য সংস্করণ ছিল।
লিথুয়ানিয়ানদের মতো পোলিশরাও অনেক আগে থেকেই ইউক্রেন বিশেষ করে গ্যালিসিয়া-ভলিনিয়ার দখল নেয়ার চেষ্টা করে যায়। পোল্যান্ডে রাজতন্ত্র ফেরানো ক্যাসিমির দ্যা গ্রেট (Casimir the Great) ক্যাথোলিক চার্চের সাহায্য আর সমর্থন নিয়ে ইউক্রেন দখলের চেষ্টায় নামে। পোল্যান্ডের ধনীব্যক্তিদের পাশাপাশি বাণিজ্যের সুযোগ আরও বেশি পাওয়ার আশায় ব্যবসায়ীরাও এসময় ক্যাসিমিরকে শক্তি যোগায়। ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দেই হাঙ্গেরির রাজা লুইসের (King Louis) সাথে ক্যাসিমির ইউক্রেন দখল এবং পরিচালনায় একে অন্যকে সাহায্য করা বিষয়ক একটি চুক্তি সম্পন্ন করে। এরপরের বছরই বলেস্লোর মৃত্যু হলে মৃত্যুর ৯ম দিনেই ক্যাসিমির গ্যালিসিয়াতে ভ্রমণ করে। তবে লিথুয়ানিয়ানদের মতো অতটা সহজে দখল করে নিতে পারেনি পোলিশরা।

হাঙ্গেরিয়ানদের সাহায্য নিয়ে পোলিশরা লম্বা সময় ধরে লিথুয়ানিয়ানদের সাথে লড়ে যায়। এই লড়াইয়ের মধ্যেই ১৩৪৯ সালে ক্যাসিমির দ্যা গ্রেট গ্যালিসিয়া এবং ভলিনিয়ার কিছুটা দখল নিতে সক্ষম হয়। ১৩৬৬ সালে পোলিশরা গ্যালিসিয়ার পূর্ণ দখল নিতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ভলিনিয়ার কিছুটাও নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। বাকিটা তখনো লিথুয়ানিয়ানদের দখলেই ছিল।

লিথুয়ানিয়ানরা ইউক্রেনের মানুষের নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা অক্ষুন্ন রাখলেও পোল্যান্ডের ক্যাসিমির তা করতে ব্যর্থ হয়। ক্যাসিমির গ্যালিসিয়াকে “The Kingdom of Rus'” হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি তাদের নিজেদের ঐতিহ্য সেখানে বজায় রাখতে চাইলেও ইতিপূর্বে ক্যাথোলিক চার্চের সাথে করা চুক্তির কারণে তা করতে ব্যর্থ হয়। ১৩৪১ সালেই ক্যাসিমির একবার পোপ বেনেডিক্ট দ্বাদশ (Pope Benedict XII) এর কাছে চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেও পোপ সেই অনুমতি তাকে দেয়নি। উলটো ক্যাথোলিক চার্চ সেসময় গ্যালিসিয়াতে থাকা অর্থোডক্সীয় কাঠামো ধ্বংসের চেষ্টা চালাতে থাকে। তখন থেকেই গ্যালিসিয়ার নিজস্ব লোকেদের সাথে পোলিশদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতিগত এক লড়াই শুরু হয় যা স্থায়ী হয়েছিল ৬০০ বছর। এই লড়াই আরও বেড়েছিলো যখন ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দের পর গ্যালিসিয়ার বলিয়ারদেরকে পোলিশদের অভিজাতদের সমান মর্যাদা দেয়ায় তারাও ক্যাথোলিক মতবাদ গ্রহন করে নেয়। একই সাথে পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে গ্যালিসিয়ায় ল্যাটিন ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয় পোলিশরা।

রাজা ক্যসিমিরে ফেরা যাক। যে হাঙ্গেরির রাজা লুইসের সাহায্য নিয়ে এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম হলো ক্যাসিমির, সেই রাজা লুইসই ছিলো ক্যাসিমির এবং পুরো পোল্যান্ডের ভয়ের কারণ। ১৩৩৯ সালে লুইসের সাথে ক্যাসিমিরের করা চুক্তির একটি ধারা ছিলো এমন যে, যদি ক্যাসিমির কোনো ছেলে সন্তান না রেখেই মারা যায় তবে ইউক্রেন এবং পোল্যান্ড চলে যাবে লুইসের রাজত্বের অধীনে। এবং ক্যাসিমির সত্যিই কোনো ছেলে সন্তান না রেখেই ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে মারা যায়। এ সময় তার কোনো ছেলে না থাকলেও ছিলো ৪ মেয়ে। এরপর হাঙ্গেরিয়ানরা ঢুকে পড়ে গ্যালিসিয়ায়। তবে একটা সময় গ্যালিসিয়াকে আবারও পুরোপুরি পোলিশদেরই অংশ করে নেয় রাণী যাদভিগা (Jadwiga of Poland)।

গ্যালিসিয়া নিয়ে লিথুয়ানিয়ানরা এবং পোলিশরা লম্বা সময় যাবৎ একে অন্যের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিল। এরপর একটা সময়ে এসে তারা উপলব্ধি করে মস্কো (Moscow) তার শক্তি বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। একই সাথে জার্মানরাও তাদের উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন-দিন। ওদিকে আবার পোল্যান্ডও আর চায় না হাংরেরির সাথে নিজেদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে, তারাও নতুন কোনো রাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে চাচ্ছিলো। ঠিক এমন সময়েই পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ধনী ব্যবসায়ীরা একটি প্রস্তাব রাখে যা সেসময় অনেককেই বিস্মিত করেছিলো। এতোদিন ধরে যে লিথুনিয়ানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো পোলিশরা, সেই লিথুনিয়ানদের সাথেই মিলে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিল তারা। মিত্রতার পথ হিসেবে তারা প্রস্তাব করেছিলো পোল্যান্ডের রাণী যাদভিগা ও লিথুয়ানিয়ানের গ্র্যান্ড প্রিন্স য্যাগিয়েলোর (Władysław II Jagiełło) বিবাহকে।

১৩৮৫ সালে বেলারুশের একটি ছোট শহরে তাদের এই বিবাহের মাধ্যমে দুটি রাষ্ট্রের শুরু হওয়া নতুন সম্পর্কের চুক্তি (Union of Krewo) সাক্ষরিত হয়। এরপরও লম্বা সময়ে লম্বা ইতিহাস আছে এই দুই দেশের, সাথে ইউক্রেনেরও।

Union of Lublin Bangla
Union of Lublin; Image Source: Wikimedia Commons

এর প্রায় ২০০ বছর পর ১৫৬৯ সালে লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডের মাঝে আরও একটি চুক্তি (Unioun of Lublin) সম্পাদিত হয় নতুন করে যার মাধ্যমে লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড একটি রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচালিত হতে থাকে, সৃষ্টি হয় পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ, ইউক্রেনের বেশিরভাগ অঞ্চলের শাসন চলে যায় সরাসরি পোলিশদের হাতে। এর পরের পুরো শতাব্দী ইউক্রেনীয়দের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় পোলিশ সংস্কৃতি।

তথ্যসূত্র:

1. Ukraine - A History by Orest Subtelny
2. History of Ukraine | Britannica
3. Jadwiga of Poland | Britannica
4. The Polish-Lithuanian Commonwealth | Oxford Bibliographies

আগের তিন পর্ব:

Md. Rabiul Mollah

Okay! So here I'm Md. Rabiul Mollah from Pathgriho Network. I'm currently a student of B.Sc in Textile Engineering Management at Bangladesh University of Textiles. facebook instagram github twitter linkedin

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺