ইউক্রেনে কৃষি কাজের শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৪০০০ অব্দের মাঝামঝি সময়ে; কেন্দ্রস্থল ছিল বাগ ও নিস্টার নদী। সেই সময় থেকেই ইউক্রেনে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। এরপর একে একে সিমেরিয়ান, সারমাশিয়ান, সিথিয়ান, ভাইকিংস, মোঙ্গল, পোলিশ, লিথুয়ানিয়ানদের আগমনে ইউক্রেনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কিছু তথ্য নিয়েই ‘ইউক্রেনের ইতিহাস’-এর ৫ম পর্ব।
প্রাচীন ইউক্রেনে মানব-বসতির বিস্তার ঘটতে থাকে কৃষিকে কেন্দ্র করেই। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে এসে ইউক্রেনে আসা সিথিয়ানরা গ্রিকদের সাথে শুরু বাণিজ্য। মোম, মধু এসবের বিনিময়ে গ্রহণ করতো মদ, অলংকারসহ অন্যান্য অনেক দামী সামগ্রীই। সিথিয়ানরা দাস-দাসীর বিনিময়েও গ্রিকদের সাথে বাণিজ্য অব্যাহত রাখে। তবে কৃষিকাজই ছিল অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থার মূল।
কিয়েভান রুশের সময়কালে ইউক্রেনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
৯ম শতাব্দীতে ইউক্রেনের ভূমিতে প্রথম রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কিয়েভান রুশ। তাদের অধীনে থাকা প্রায় ৮ লাখ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে ঠিক কত মানুষের বসবাস ছিল তা নিয়ে পাওয়া যায় বিভিন্ন মত। তবে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যাটা ৩ মিলিয়ন থেকে ১২ মিলিয়নের মধ্যে ছিল বলে ঐতিহাসিকগণের ধারনা। কিয়েভান রুশ মূলত বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক কোনো সত্তার মতো ছিলো না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল অনেকটা ভারতবর্ষ শাসন করা ব্রিটেনের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই। এই কিয়ভান রুশের হাত ধরেই ইউক্রেন হয়ে ওঠে সুবিশাল এক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্রের মতো। এই বাণিজ্য কেন্দ্রিক সময়েও ইউক্রেনে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল আগের মতোই।
সেসময় কাস্পিয়ান সাগরে (Caspian Sea) মুসলিম সভ্যতার সাথেও তাদের বাণিজ্য হয়। কনস্ট্যান্টিপোলও (Constantipole) ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠতে থাকে। ‘কিয়েভান রুশ’-এর সময়কালে ইউক্রেনের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩-১৫% লোক শহরে থাকতো। সেসময় ইউক্রেনে মোট ২৪০টির মতো শহর ছিল বলে ধারনা করা হয়ে থাকে। তবে সংখ্যাটা অন্তত পক্ষে ১৫০ হবেই এমনটাই ধারনা করেন ঐতিহাসিকগণেরা। এই ১৫০টি শহরের মধ্যে ৯০টি ছিল বড় এবং কিয়েভ ছিল সেসময়ের সর্ববৃহৎ শহর। মোঙ্গলরা ইউক্রেনে আসার আগে কিয়েভের জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার। তার প্রায় এক শতাব্দী পর লন্ডন জনসংখ্যার দিক থেকে কিয়েভের কাছাকাছি আসতে পারে। সেসময় গ্যালিসিয়া-ভলিনিয়ার জনসংখ্যা ছিলো মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার।
খুব দীর্ঘ একটা সময় ধরে চলে কিয়েভান রুশের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। তবে কনস্ট্যান্টিপোলের বাণিজ্য পথে যাযাবরদের আক্রমণ এবং লুটপাটের কারণে অনেকেই নিজেদের বাণিজ্যিক পরিচয় ভুলে গিয়ে ধীরে ধীরে হতে থাকে ভূ-স্বামী। ইউক্রেনে বাড়তে থাকে জমিদারের সংখ্যা। একটা পর্যায়ে গিয়ে জমিদারী প্রথাও শুরু হয়ে যায় ইউক্রেনে।
ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে জমিদারি প্রথা বাড়তে থাকলেও কৃষকরা তখনো পর্যন্ত ছিল স্বাধীন। তাদের আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল, ইউক্রেনের যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে থাকতে পারতো, মৃত্যুর পর তাদের চাষাবাদকৃত জমিতে তাদের ছেলেরা চাষাবাদ করতে পারতো। তবে সেসময়ের সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে এটা স্বাভাবিক যে, যদি কোনো কৃষক কোনো ছেলে সন্তান না রেখেই মারা যেত তবে জমি হাতছাড়া হয়ে যেত। কৃষকদের তখন শুধু কর দিতে হতো। এর বাইরে, কোনো বহিঃশত্রুর সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেলে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে বাধ্য ছিল কৃষকরা। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কৃষকরা কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যায়। তবে সেসময়েও তারা সকলেই ছিল ঐক্যবদ্ধ।
কৃষকরাসহ অন্য কেউ যদি জমিদারের ঋণচক্রে আটকে যেত, তবে চুক্তি অনুযায়ী শ্রম দিয়ে তা পরিশোধ করার সুযোগ ছিল। অগ্রিম ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও এমন কিছু রীতিনীতির আভাস পাওয়া যায় ইতিহাস থেকে।
সেসময়ে ইউক্রেনের কৃষক শ্রেণিকে বলা হতো ‘Zakupy’। সমাজে সবথেকে নিম্নশ্রেণীর ধরা হতো কৃতদাসদের। তাদেরকে বলা হতো ‘Kholopy’। তবে দাসদেরও সুযোগ ছিলো অর্থ বা চুক্তি অনুযায়ী অন্য কিছুর বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়ার। এছাড়া সেসময় ভালো কাজের বিনিময়ে দাস-দাসীরা আলাদাভাবে পুরষ্কৃতও হতো।
পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ
ইউনিয়ন অব লুবলিনের পর থেকে পশ্চিমের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে ইউক্রেনের। তার আগেই অবশ্য কিয়েভান রুশের সময়কালে ইউক্রেনের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল তা থেকে একেবারে আলাদা একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল সেখানে। এরপর যখন পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন ওই অঞ্চলের ব্যপক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। সেসময় এই কমনওয়েলথ ছিল ইউরোপের সবথেকে বড় অংশ। এর জনসংখ্যা ছিলো মোট ৭.৫ মিলিয়ন যার ২৮% বা প্রায় ২ মিলিয়নই ইউক্রেনিয়ানরা। জনগোষ্ঠীর বাকি অংশ লিথুয়ানিয়ান, বেলারুশিয়ান, জার্মানীয় এবং কিছু অন্যান্য অধিবাসীদের নিয়ে গঠিত ছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান শাসকেরা নতুন নতুন শহর স্থাপন করতে শুরু করে এবং পুরোনো শহরগুলোকে আরও বিস্তার লাভ করাতে থাকে। এর মূল কারণগুলোর একটি ছিল রাজস্ব বাড়ানোর পথ তৈরি করা। একটা সময়ে গিয়ে বাণিজ্য রাস্তা পরিবর্তনসহ তাতারদের (Tatar) আক্রমণের কারণে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের মাত্র ৩ হাজার মানুষ বসবাস করতো কিয়েভে।
১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের পর কমনওয়েলথের অন্তর্ভূক্ত ইউক্রেনের মূল ভূখন্ড মোট ৬টি ভাগে ভাগ হয়। এই ৬টি অঞ্চলের নাম ছিল সেসময় গ্যালিসিয়া (Galicia), ভলিনিয়া (Volhynia), পডিলিয়া (Podilia), কিয়েভ (Kiev), ব্রাটস্ল্যাভ (Bratzslav) এবং বেলজ (Belz)। বেলজের অন্তর্গত ছিলো আলাদা দুটি অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে আয়তনে সবথেকে বড় ছিলো কিয়েভ (আনুমানিক ১,১৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার), ২য় সর্ববৃহৎ অঞ্চল ছিলো গ্যালিসিয়া (আনুমানিক ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার)। ৪২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে ৩য় সর্ববৃহৎ অঞ্চল ছিলো তখন ভলিনিয়া। কিয়েভ অনেক বড় হলেও সেসময়ে কিয়েভে জনসংখ্যা ছিলো তুলনামূলক অনেক কম। সেখানে মানুষের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২,৩৪,০০০ জনের মতো। সবথেকে বেশি মানুষের বসবাস ছিলো তখন গ্যালিসিয়াতে। গ্যালিসিয়াতে তখন মানুষের সংখ্যা ছিলো আনুমানিক ৪,৪৬,০০০ জন। সবথেকে কম জনসংখ্যা ছিল পডিলিয়ায়; ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে মানুষ ছিল ৯৮ হাজার জন। প্রতি বর্গ কিলোমিটারের হিসেবে সবথেকে বেশি মানব বসতি ছিল বেলজের অন্তর্গত পিডিলিয়াসিয়া (Pidiliassia) অঞ্চলে (২৪ জন) এবং সবথেকে কম ছিল কিয়েভে (মাত্র ২ জন)।
ইউক্রেনে ভূ-জমিদারিত্ব বাড়তে থাকার একটা পর্যায়ে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের সময়ে ভলিনিয়ার ৩০% জমির (প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার) মালিক ছিল শুধু Ostrezky (অস্ট্রেজকি) পরিবার। এছাড়া আরও অনেক পরিবারই ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশাল অংশের মালিক ছিল সেসময়।
এই সময়টাতে এসেও ইউক্রেনের ৮০% জনগোষ্ঠী কৃষিকাজের সাথেই সরাসরি জড়িত ছিল। এই সময়ে স্বচ্ছল কৃষকদের সংখ্যা ছিল অনেক। ২০ থেকে ৩০ একর জমি, ঘোড়া, ষাড়, গরু, মুরগি এসবের মালিক ছিলো অনেক কৃষকই। তখন অধিকাংশ কৃষিকাজই ছিলো মূলত নিজেদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনের সরাসরি যোগান দেয়া এবং পরবর্তী বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণের জন্য।
খাদ্যাভ্যাসের কথা বলতে গেলে বলা যায় সেসময়ের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল রুটি এবং বিয়ার। অন্যান্য খাবারের মধ্যে ছিল কাশা, পনির, ডিম ও বিভিন্ন ফলমূল। সাধারণ লোকেরা মাংস খেতো শুধু বড় কোনো উৎসবে। যারা কিছুটা ধনী ছিল তারাও মোটামুটি একই খাবার আহার করতো, শুধু তাদের মাংস খাওয়ার পরিমানটা ছিল সাধারন মানুষদের তুলনায় খানিক বেশি। মিষ্টি জাতীয় খাবার ইউক্রেনে তখন প্রায় ছিল না বললেই চলে। তবে গরীব কৃষকরা এবং শহরের শ্রমীকরা তখনও ক্ষুধার্থ অবস্থাতেই কাটিয়েছে অনেক দিন।
এতো বছর ধরে কৃষকরা মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকার মূল কারণ ছিলো সমাজের ধনী লোকেরাও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তবে সম্ভাবনা কমে যাওয়া, রাজনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে সময় দেয়াসহ আরও কিছু কারণে তারা কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমাজের এই স্তরের লোকেরা সরাসরি কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলে কপাল পুড়ে কৃষকদের। একটা সময় কৃষকদেরকে মজুর হিসেবে কাজ করতে হয়েছে, সেটাও অল্প পারিশ্রমিকে। কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকলে এক সময় তারা বিদ্রোহও করে। তবে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ধনী শ্রেণির সাথে পেরে ওঠেনি। পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের একটা পর্যায়ে এসে ধনীরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে যেখানে কৃষকসহ অন্যান্য আরও অনেকেই হয় অধিকার বঞ্চিত। এমন এক অসম আর্থ-সামাজিক অবস্থার চেহারাই ইউক্রেনে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত।
ইউক্রেনের ইতিহাসের চতুর্থ পর্বে পড়ুন ইউক্রেনের ইতিহাস: পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান অধ্যায়। এছাড়া প্রথম তিনটি পর্ব পড়ুন রোর মিডিয়া থেকে যার লিংক পাবেন চতুর্থ পর্বে।