সারা জীবনই শিক্ষা গ্রহনের সময়। তবে ছাত্র জীবনের শিক্ষাগ্রহন ঠিকভাবে না হলে পরবর্তী জীবনে শিক্ষা গ্রহন করার সুযোগও সেভাবে পাওয়া যায় না। জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে চাকরি করতে হয়, টাকা আয় করতে হয়, নিজের পরিবার নিয়ে অন্তত সুখে থাকতে হয়। তাই শিক্ষা যা লাভ করার তার অধিকাংশ (প্রায় পুরোটাই) হওয়া উচিত ছাত্রজীবনেই। বাকি জীবনে অভিজ্ঞতা থেকে, পরিস্থিতির চাহিদায় অনেক কিছুই শেখার প্রয়োজন হবে এবং শেখাও যাবে। তবে ছাত্র জীবনে যেসব বিষয়ে স্কিলড হওয়ার সুযোগ থাকে, সেসব বিষয়ে ছাত্র জীবনেই পারদর্শী হওয়া উচিত। আজকে আমি এই লেখায় এমন ১৩টি বিষয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। তাহলে শুরু করা যাক।
১. মানুষের সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা
মানুষের সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে যাচাই-বাঁছাই করেই মিশতে হবে। এমন মানুষের সাথে মেশা উচিত হবে না যার থেকে আমি কোনো বদ অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে পারি। ভালো, শিক্ষিত, স্কিলড মানুষের সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে। নতুন কলেজ কিংবা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই না, এর বাইরের মানুষের সাথেও মেশা উচিত, পরিচিত হওয়া উচিত। তবে মনে রাখতে হবে, নিজেকে হাসি তামাশার পাত্র বানানো যাবে না কিংবা সোজা বাংলায় যাকে 'পা চাটা' বলে সেটাও না। নিজের স্কিল, নিজের প্রতিভা দিয়েই মানুষের সাথে মিশতে হবে। তৈলাক্ত কথাবার্তা দিয়ে নয়।
২. ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং সমস্যার সমাধান করতে পারা
বর্তমান পৃথিবীতে সাফল্য পেতে, অনেক সময় শুধু টিকে থাকতেই ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের প্রয়োজন হয়। শিক্ষাজীবনে তো ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং প্রবলেম সলভিং স্কিল দুটি থাকাই চাই। সমস্যার সমাধান করতে না পারলে বইয়ে লেখা পাঠ চুকিয়ে ভালো ফলাফল করেও তেমন কোনো লাভ হয় না। সমস্যার সমাধান করার মতো চিন্তা করতে পারা, ইনোভেটিভ কোনো কিছু খুঁজে বের করতে পারার ক্ষমতা বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে প্রয়োজনীয় স্কিল গুলোর একটি।
মানুষ যখন তখন ভাড়ার গাড়ি নির্দিষ্ট ভাড়ায় পায় না- এর সমাধান দিতে গিয়েই উবার, পাঠাওয়ের আগমণ। মানুষ সাজানো অবস্থায় যেকোনো তথ্য সহজে খুঁজে পায় না। এর সমাধান দিতে গিয়েই গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনের আগমণ। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে পড়াশুনার জন্য ভালো রিসোর্স পায় না- এর সমাধান দিতে এসেই খান অ্যাকাডেমি, খান অ্যাকাডেমির আইডিয়া থেকেই টেন মিনিট স্কুলের আগমণ, বাইজুসের মতো ইজুটেক প্রতিষ্ঠানের আগমণ। ঘরে বসে খাবার খেতে ইচ্ছে করলে কী করব? ফুডপান্ডারা সেখান থেকেই এসেছে। ঘরে বসে পণ্য কেনার চাহিদা থেকেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এসেছে। সমস্যার সমাধান দিতে এসেই বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর হাতেখড়ি। সমস্যার সমাধান করতে পারার শুরুটা স্কুল লেভেলেই শুরু করে দিতে হবে বড়সড় রকমের।
৩. তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারার ক্ষমতা
একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য হলো সবথেকে বড় সম্পদ। আমরা এমন কথা শুনে থাকবো যে আমাদের সম্পর্কে আমাদের নিজেদের থেকেও গুগল বেশি জানে। একটু চিন্তা করে দেখা যাক। আমাদের যেকোনো কিছু মাথায় আসলেই আমরা হয়তো গুগলে গিয়ে সার্চ করি, আমাদের ফটোগুলো আমরা গুগল ফটোসে ব্যাকআপ রাখি, আমাদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে গুগল ম্যাপে তা খুঁজি। গুগল কিন্তু আমাদের সবকিছুই জেনে যাচ্ছে; গুগল এভাবেই গড়ে তুলেছে তথ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার।
ফেসবুকের দিকে তাকানো যাক। আমরা কোন স্কুলে পড়েছি, কোন কলেজে পড়েছি, আমার ইন্টারেস্ট কিসে, আমি আজ কোথায় গেলাম (চেক-ইন), কোন ধরনের মানুষকে আমার পছন্দ (পেজ এবং প্রোফাইল ফলো), কী ধরনের খাবার আমি পছন্দ করি (খাবার খেতে গিয়ে আমাদের তোলা সেলফি যা আমরা ফেসবুকে আপলোড করি), আমি কবে বিয়ে করতে যাচ্ছি, কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি তার কোন বিষয়গুলোতে আগ্রহ- এসবই কিন্তু ফেসবুক জেনে যাচ্ছে।
এতে তাদের লাভ কী? ফেসবুক আপনাকে ওই বিষয়ের উপরেই বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যাবে। আপনার তথ্য তার অ্যানালাইজ করে বিশাল অংকের টাকা আয় করবে। তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা এখনকার পৃথিবীতে খুব বড় একটি সম্পদ। তাইতো দিনে দিনে ডেটা সায়েন্টিস্টদের সংখ্যা এবং চাহিদা বাড়ছেই।
৪. লিডারশিপ
নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অনেক বিশাল এক স্কিল। স্কু, কলেজে যখন কোনো প্রোগ্রাম হয় কিংবা ভার্সিটিত প্রবেশ করেই যখন কোনো প্রোগ্রাম পাওয়া যায় তখন সেখানে অন্তত নিজেদের ৪-৫ জনের দলকে দলেও লিড দিয়ে প্র্যাকটিস করতে হবে লিডারশিপের। যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের দেখে দেখে শিখতে হবে। খুব দেড়ি হয়ে যাওয়ার আগেই এই স্কিল আয়ত্বে নিতে হবে।
৫. পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারা
যেকোনো সময়ই যেকোনো কিছু পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এর সবথেকে বড় উদাহারণটি আমরা পেয়েছি এই মহামারীর সময়। হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবীকে এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, যা কেউ কোনোদিন হয়তো কল্পনাও করেনি। তবে এর সাথেও কিন্তু মানিয়ে নিতে হয়েছে। মানিয়ে নিতে হবে, যারা মানিয়ে নিতে পারেনি তারা অনেক বেশি পিছিয়ে পরেছে। এটা তো অনেক বড় পরিবর্তন। খুব ছোট ছোট অনেক পরিবর্তনও আসবে আমাদের জীবনে। সেসবের সাথেও মানিয়ে নিতে হবে আমাদের। এটা লাগবেই।
৬. টিমওয়ার্ক অ্যাবিলিটি
নিজে নিজে অনেক ভালো, জ্ঞানি, প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি; কিন্তু টিমের সাথে কাজ করতে পারি না, টিম মেম্বারদের সাথে মানিয়ে চলতে পারি না, নেগোসিয়েট করতে পারি না কিংবা নিজের সিদ্ধান্তই সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা কিংবা অন্যের উপর পুরোপুরি ভরসা করে বসে থাকার অভ্যাস- এর সবগুলোই একজন ভালো টিমওয়ার্কার হওয়ার পথের বড় অন্তরায়। এসব কাটিয়ে ওঠতে হবে। টিম মেম্বারদের সাথে কাজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
৭. পারসোনাল ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট
একজন শিক্ষার্থী নিজে টাকা আয় করুক কিংবা পরিবার থেকে তার খরচের টাকা নিক; যেটিই হোক না কেন বুঝে শুনে ব্যয় করতে পারার আর্টটা আয়ত্ব করতে হবে। যেখানে খরচ করা প্রয়োজন, যেখানে খরচ করলে প্রতক্ষভাবে কোনো লাভ হোক বা না হোক, পরোক্ষভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে খরচ করতে হবে। আবার অপ্রয়োজনে অনেক বেশি খরচ করার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। ছাত্রজীবনে যেসকল ছাত্র নিজেই নিজের টাকা আয় করতে শুরু করে, তখন অনেকেই অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ করে থাকে। এই বদঅভ্যাস বাদ দিতে হবে। কীভাবে কোথায় টাকা খরচ করবে তার পরিকল্পনা করতে হবে।
৮. টাইম ম্যানেজমেন্ট
শুধু ছাত্রজীবন না, সারাজীবনই এর প্রয়োজন অনেক বেশি। এর অনুশীলনের শুরুটাও ছাত্রজীবন থেকেই হওয়া উচিত। আমরা অনেকেই আছি যারা বিভিন্ন পরিকল্পনা করি সময় কীভাবে কাটাবো তা নিয়ে, অনেকেই ডেইলি রুটিন, মান্থলি টু ডু কিংবা ইয়ারলি রেজুলুশন তৈরি করি, কিন্তু মেনে চলতে পারি না। এই মেনে চলতে না পারার অভ্যাস ত্যাগ করাটা অনেক বেশি জরুরি।
৯. গুছিয়ে বলতে পারার ক্ষমতা
এমন অনেকেই আছি যারা নিজে খুব ভালো বুঝি বা আমার সিদ্ধান্তের পক্ষে আমার কাছে যুক্তি আছে এবং এই যুক্তি অন্য কারো সামনে উপস্থাপন করলে সেও মেনে নেবে। কিন্তু আমরা উপস্থাপন করতে পারিনা। আমরা গুছিয়ে বলতে পারি না। গুছিয়ে বলতে না পারাটা অনেক বড় একটি সমস্যা। সুন্দর করে নিজের যুক্তি তর্ক গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারা উচিত আমাদের প্রত্যেকেরই। এটি আয়ত্বে আনার জন্য সহায়ক হতে পারে বিতর্ক শোনা, বিতর্ক করা, প্রেজেন্টেশন দেয়া, অন্যদের প্রেজেন্টেশন শোনা।
১০. ভালো ইংরেজি বলতে পারা
ইংরেজি ভালোভাবে বলতে পারাটা এসময়ের পৃথিবীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশ বিদেশের অনেকের সাথেই আমাদের যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজন হয়। এবং সেখানে আমাদেরকে ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করতে হয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া ইংরেজিতে হয়, দেশের বাইরে থেকে অনলাইন কোনো কোর্স করতে গেলেও ইংরেজিতে করতে হয়, দেশের বাইরে জব করতে গেলে ইংরেজি খুব ভালোভাবে জানতে হয়, দেশের ভেতর থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করতে গেলে বিদেশী বায়ারদের সাথে ভালো ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। তাই এখন থেকেই ভালো ইংরেজি জানার শুরুটা করতে হবে। পাশাপাশি IELTS, GRE এর ব্যাপার তো আছেই।
১১. স্লাইড তৈরি
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শুরু করে জব লাইফে স্লাইড তৈরির স্কিলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্কিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রেজেন্টেশন দেয়ার সময়, কেস কম্পিটিশন, জব লাইফের প্রেজেন্টেশন, ছাত্রদের মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পড়ানো- সব জায়গাতেই স্লাইড তৈরি করতে হয়। প্রফেশনাল স্লাইড তৈরি করতে পারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি স্কিল। পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করা শিখতে হবে এজন্য সবাইকেই। পাওয়ারপয়েন্ট ছাড়াও স্লাইড বানানো যায়, ক্যানভার মতো অনলাইন এডিটরও ব্যবহার করা যায়- তবে মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট শেখাটাই বেশি কাজে দেবে। ছাত্র হিসেবে মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট ফ্রি তে কীভাবে পেতে হয় জানতে চাইলে পড়ুন: কীভাবে শিক্ষার্থী হিসেবে ফ্রিতে মাইক্রোসফট অফিস ৩৬৫ পাব?
১২. লেখালেখি করতে পারা
শিক্ষার্থীদের একটা বিশাল অংশ এক সময় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করবে। তাদেরক গবেষণাকে লেখার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে হবে। তাই কীভাবে একটি রিসার্চ পেপার লিখতে হয় সেটা জানতে হবে। তবে শুরুতেই রিসার্চ পেপার লেখার নিয়ম না জানলেও ক্ষতি নেই। অন্তত কীভাবে একটি ভালো ইনফরমেটিক আর্টিকেল লিখতে হয়, তা জানা থাকতেই হবে। এজন্য ফেসবুকে বিভিন্ন ভালো গ্রুপ, অনলাইনের রোর বাংলার মতো কোনো ভালো প্লাটফর্ম কিংবা জাতীয় দৈনিকে লেখা প্রকাশ করা যেতে পারে। চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটেও লেখা প্রকাশ করা যাবে। পাঠগৃহে লেখা প্রকাশ করতে চাইলে নিচের ভিডিয়োটি দেখে নেয়া যেতে পারে।
এমন আরও অনেক প্রয়োজনীয় স্কিল আছে যা একজন শিক্ষার্থীর শেখা উচিত ছাত্রজীবনেই। লেখাপড়ার পাশাপাশি এসব দিকে মনোযোগী হতে হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। তবেই একদিন আল্লাহর রহমতে সফল হওয়া যাবে নিজের লক্ষ্যে।