স্বাধীন-বাংলাদেশের-অভ্যুদয়ের-ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি বড় ভূমিকা পালন করে। স্বৈরাচারী শাসকের পতন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কর্তৃত্বের অবসান, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ছয় দফা ও এগার দফার ভিত্তিতে যে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে এবং সামরিক শাসক আইয়ুব শাহীর পতন ঘটায় ইতিহাসে তাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই অংশ থেকে যে সকল প্রশ্ন করা হয়ে থাকে তার মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও এর ফলাফল ব্যাখ্যা করা সম্পর্কিত প্রশ্নটি সবথেকে বেশি আসতে দেখা যায়। এই লেখাটি পড়ার পরে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আপনার ধারণা তৈরি হবে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পিছনে বিভিন্ন কারণ দায়ী ছিল। নিচে সে সকল কারণ আলোচনা কর হলো:
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য
গণঅভ্যুত্থানের সবথেকে বড় কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে বৈষম্য। অর্থাৎ সে সময়ে বাঙ্গালীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছিল। তারা মুলত এই অঞ্চলের মানুষদেরকে চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন ধরনের সুবিধা দিতেন না বরঞ্চ এই অঞ্চল থেকে তারা সম্পদ নিয়ে যেতেন। একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্য বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। মূলত এই বৈষম্যের বারুদ পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের বিস্ফোরণ ঘটাতে সাহায্য করে।
আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও আমলাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে তারা নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করত। আইয়ুবী শাসনামলে এটা আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। বাংলার সচেতন জনসাধারণ এটাকে মেনে নিতে পারে নি। তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
সরকারি দমননীতি
সারা পাকিস্তানের গণতন্ত্রমনা জনগণ যখন আইয়ুব খানের একনায়কত্বসুলভ শাসনে অসহিষ্ণু হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে সরকার তখন গণঅসন্তোষ দমনের জন্য নির্যাতন ও নিপীড়নের হস্ত সম্প্রসারিত করে। ফলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ জেল জুলুমের শিকার হয়। মূলত এ নিপীড়ন এতটাই চরম সীমায় যায় যে সরকার যাদেরকে নিজেদের পতনের কারণ হিসেবে মনে করত তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির আদেশ দিচ্ছিলেন। এই কারণে সাধারণ জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। সরকারি দমন-পীড়ন যতই চরমে উঠে বিক্ষোভের মাত্রা ততই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় কোনো প্রকার কার্যকরী ব্যবস্থা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনোই করে নি। ফলে, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। তাতে করে বাঙালিদের মধ্যে এমন একটি ধারণা জন্মায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই আমাদেরকে ব্যবহার করবে। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে মনে করে না। তাছাড়া পাকিস্তানের শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে সেনাশাসনে। তাই বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।
জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব বাংলা থেকে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্য হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এ চেতনার সফল প্রয়োগ ঘটে। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬-দফা কর্মসূচি জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটায়। অতঃপর বিকশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে অত্যাচার ও জুলুমের হাত থেকে মুক্তির আশায় গণআন্দোলনের সূচনা করে।
আরো পড়ুন: বঙ্গবঙ্গের কারণসমূহ লেখ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের তাৎক্ষণিক ফলাফল ছিল আইয়ুব খানের পতন, সামরিক শাসন জারি এবং ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখল। এছাড়াও আরও অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলো বাঙালি জাতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জনবল এবং ক্ষমতা অন্যদের সামনে প্রকাশিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় এবং শাসনতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই শাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে হাজার ১৯৬৮ সালের ১৯ জুনের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসান ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারে তাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ ষড়যন্ত্র করে আগরতলা মামলা সাজিয়েছিলেন।
এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা সমূহের অনেকগুলো প্রত্যাহার করা হয়। গণআন্দোলনের মাধ্যমে মূলত শেখ মুজিবসহ আরো রাজবন্দিদের মুক্তি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ যারা পূর্ববাংলার মুক্তির জন্য বিভিন্ন কাজ করছিলেন তাদের উপর থেকে সরাসরিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের আগ্রাসন অনেকটা কমে যায়।
গণঅভ্যুত্থানের কারণে আইয়ুব সরকার জনগণের নিকট নতি স্বীকার করে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক ডাকতে বাধ্য হন।
বর্তমানে বাংলাদেশে গঠিত হওয়ার পিছনে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অনেক বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি আশা খুঁজে পেয়েছিল। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের শক্তি প্রদর্শন এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটি ইচ্ছা সকলের সামনে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত পরবর্তীতে এর জের ধরে ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন আন্দোলন এবং শোষণের বিরুদ্ধে অবরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাই বলা যায় যে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি অধ্যায়।