আপনি এখন যা পড়ছেন তা একটি ই-বুক, এতো বড় পরিসরে লেখকের প্রথম কোনো চেষ্টা। শচীনকে নিয়ে লিখবে সে। কিন্তু কী লিখবে? জীবনী না কি ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পরিসংখ্যান? কোনোটি লেখার যোগ্যতাই লেখক হিসেবে আমার নেই, তবুও কিছু একটা তো চেষ্টা করছি। এই চেষ্টার ফলই এই ই-বুক।
কিন্তু ওই যে, কী লিখব? এতোক্ষণ পর্যন্ত পড়ে আশা করি এটুকু স্পষ্ট হয়েছে যে, এটা ব্যক্তি শচীনকে নিয়ে লেখা না, ক্রিকেটার শচীনকে নিয়েই লেখা। কিন্তু ক্রিকেটার শচীনেরই কোন দিকটা নিয়ে? শুধু ঘটনাপ্রবাহ? তেমনটা হলে এপর্যায়ে এসে শচীনের প্রথম বিশ্বকাপের গল্প আসতো, তবে তা এখনই আসছে না। বাকি লেখাটুকুতে ঘটনার ধারাবাহিকতা কতটা বজায় রাখতে পারবো তাও বলতে পারছিনা। তবে এখন আপনারা কী পড়তে যাচ্ছেন তা জানাতেই পারি। ওহ হ্যাঁ, তা তো আপনারা শিরোনাম থেকেই জেনে গেছেন। শচীনের খেলা প্রথম বিশ্বকাপের পরপর সে বছরই ভারত দলের অধিনায়কত্ব পান শচীন। আপাতত গল্পটা আর পরিসংখ্যানের কাটাছেঁড়া সে বিষয় নিয়েই।
শিরোনামটা দেখেছেন। শিরোনাম দেখে বলে ওঠতেই পারেন “যত বড় মুখ নয়, ততো বড় কথা?” সর্বকালের সবথেকে ব্যর্থ ক্রিকেট অধিনায়ক শচীন? আপনি যত বড় শচীন ভক্তই হোন না কেন, এই একটি স্টেটমেন্ট এড়িয়ে যেতে চাইলে বেগ পেতে হবে অনেক বেশি। যেই বিবেচনাতেই আপনি ৫ জন ব্যর্থঅধিনায়কের তালিকা করুন না কেন, তাতে শচীন রমেশ টেনডুলকারের নামটা থাকবেই। এসব নিয়ে শেষে কথা বলি, আপাতত অধিনায়ক শচীন নিয়ে শুরু করা যাক সিদ্ধান্তে না গিয়ে।
’৯৬ এর বিশ্বকাপের কিছু পর শচীন টেন্ডুলকারকে ভারত দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করে বিসিসিআই। অধিনায়কত্বের মতো গুরুদায়িত্ব শচীনের জন্য এটা প্রথমবার না। রঞ্জি ট্রফি, দিলীপ ট্রফির মতো টুর্নামেন্টে এর আগেও অধিনায়কের দায়িত্ব সামলেছেন শচীন। তবে এবার তো জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব; সম্মান আর দায়িত্ব- দুটোই ঢের বেশি।
ভারতের জার্সিতে প্রথমবার শচীন টস করতে নামেন ২৮ আগস্ট ১৯৯৬-এ শ্রীলংকার প্রেমাদাসায় শ্রীলংকার বিপক্ষে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে শুরুর দিনটা শচীনের কেটেছে মিশ্র অভিজ্ঞতায়। টস করতে নেমে নিজের প্রথম টস জিতে নেন শচীন, আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। নতুন দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও শচীন চাপহীন থেকে খেলে গেলেন রান আউট হয়ে ফেরার আগ পর্যন্ত, খেললেন ১৩৮ বলে ১১০ রানের ইনিংস। ওই পর্যন্তই; প্রথম ম্যাচের বাকিটা হতাশার। সদ্য সাবেক ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিনের ৫৮ আর শচীনের ১১০ ছাড়া বাকি কেউওই তেমন কিছুই করতে পারলো না। পুরো ৫০ ওভারে ২২৬/৫ ছিলো ভারতের সংগ্রহ, খারাপ বলার সুযোগ নেই। তবে দিনশেষে জয়টা লংকানরাই পায়; তাও আবার ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। যে একটা মাত্র উইকেট হারিয়েছিলো শ্রীলংকা, সেটিও আবার নিয়েছিলেন শচীনই, তাও আবার বোল্ড করে।
ওডিআই যাত্রা হার দিয়ে শুরু হলেও শচীনের টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি যাত্রার শুরু হয় জয় দিয়েই। ১০ অক্টোবর ১৯৯৬, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাদা পোশাকে টস করেন শচীন। প্রথম ওয়ানডের সব বিপরীত ব্যাপারগুলোই হতে থাকে প্রথম টেস্টে। টস হারা, দুই ইনিংসে ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১০ আর ০ তে থাকা, ম্যাচ জেতা- সবই বিপরীত। ৭ উইকেটে ম্যাচটা জিতে নেয় শচীনের দল। তবে শুরুটা ভালো হলেই যে বাকি বছরগুলোও ভালো কেটেছে তেমনটা মোটেও নয়, হার আর হার এড়ানো ড্রয়ের চক্রে ঘুরপাক খাওয়া শুরু হতে বেশিদিন লাগেনি।
এতো গেলো শুরুটা। এবার শচীনের ক্যাপ্টেন্সিকে ৪টি ভাগে ভাগ করে আলাদা আলাদাভাবে নেড়েচেড়ে দেখা যাক। নাড়াচাড়ার বিষয়গুলো
১. ক্যাপ্টেন শচীন
২. টেস্ট ক্যাপ্টেন শচীন
৩. ওয়ানডে ক্যাপ্টেন শচীন
৪. ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় শচীনের নিজের পারফরমেন্স
ক্যাপ্টেন শচীন
ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থতার দিক থেকেও সেরাদের একজন। পরিসংখ্যানগত দিক বিবেচনায় ভারতের সবথেকে বাজে অধিনায়কের তকমার পাশাপাশি বিশ্ব ক্রিকেটের ব্যর্থ ৫ অধিনায়কদের তালিকা করলে সেখানেও জায়গা হবে শচীনের। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শচীন ভারত দলকে নেতৃত্ব দেয় ৭৩ ওডিআই আর ২৫ টেস্টে। এর মাঝে ওডিআইতে জয় আছে মাত্র ২৩টি আর টেস্টে ৪টি। টেস্টে বাকি ২১ ম্যাচের ১২টি ড্র আর ৯টি হার।
টেস্ট ক্যাপ্টেন শচীন
অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দুই ম্যাচ ভালোভাবেই জিতে নেয় শচীন। তবে হারের শুরুটা ৩য় ম্যাচ থেকেই। ইডেন গার্ডেনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩২৯ রানের বড় ব্যবধানে হারে শচীনের দল। পরেরটা জিতলেও তারপর আবার একটা জয় পেতে শচীনের লেগেছে ১৫ ম্যাচ। মোট ২৫টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামা শচীন জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে মাত্র ৪টিতে যেখানে একদম শুরুর ৪ ম্যাচেই ছিলো ৩টি জয়।
খুব দরকারি না কিংবা একেবারেই দরকারি না হলেও কেউ কেউ দরকার মতো মিলিয়ে নিতে পারেন এমন কিছু বাড়তি পরিসংখ্যান:
- এই ২৫ টেস্টের ১৫টিতে শচীন টস জিতেছেন, হেরেছে ১০টিতে।
- আগে ব্যাট করেছেন ১২ ম্যাচে আর আগে বোলিং বাকি ১৩ ম্যাচে।
- ১৫ বার টস জিতে ১০ বারই ব্যাটিং নিয়েছেন, টস হেরে ব্যাট করেছেন ২ বার। (শ্রীলংকা আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাঠেই।)
- জয়ী ৪ ম্যাচের দুটিতে আগে ব্যাট করেছে ভারত, দুটিতে পরে।
- ৪ জয়ের ৪টিই ভারতের মাটিতে।
- শচীনের অধীনে ভারত দল টানা ৮ ম্যাচ ড্র করে। একই অধিনায়কের অধীনে টানা ৮ ড্র রেকর্ড বুকে বিরল।
ওয়ানডে ক্যাপ্টেন শচীন
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের অধিনায়কত্বের শুরুটা যে ৫০ ওভার ক্রিকেট দিয়েই হয়েছিলো সেটা তো আগেই জানিয়েছি। প্রথম ম্যাচে ৯ উইকেটের হার, পরের ম্যাচে ৭ উইকেটের জয়, এরপর আবার ৩ উইকেটে হার, তারপর ৮ উইকেটের জয়, তারপরের দুটিও ২ উইকেটের হার আর ৫৫ রানের জয়। প্রথম ৬ ম্যাচে ৩ জয়, ৩ হারের পর টানা ৩ হার দিয়ে হারের বৃত্তে ঢুকে পড়ে শচীনের ভারত। অধিনায়কত্বের শেষে এসে পরিসংখ্যান বলে শচীনের অধিনায়কত্বে ভারত দল ৭৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র ২৩টি আর হেরেছে ৪৩টি, ১ ম্যাচ টাই আর ৬ ম্যাচে কোনো ফল আসেনি।
টেস্টের মতোই কিছু অপ্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান ওডিআইয়ের ক্ষেত্রেও তুলে দিলাম, যদিও ক্রিকেটের এই ফরমেটে এসবের গুরুত্বটা টেস্টের মতো ততটা ওজনদার না।
- এই ফরমেটেও বেশিরভাগ টস শচীনই জিতেছেন। ৪২ টস জয়ের বিপরীতে টস হার ৩১টি।
- টস জয় করা ৪২ ম্যাচে শচীনের ভারত হেরেছে ২৫ টিতেই।
- টস জিতে শচীন ব্যাটিং নিয়েছেন ২৪ ম্যাচে, বোলিং ১৮টিতে।
- ২৩ জয়ের ১১টি এসেছে আগে ব্যাট করে আর ১২টি পরে ব্যাট করে।
১৯৯৮ এর শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত, পাকিস্তানকে নিয়ে করা টুর্নামেন্ট থেকে শচীনকে সরিয়ে আবারও অধিনায়ক করা হয় আজহারকে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত টেস্ট আর ওডিআই দুই ফরমেটেই অধিনায়কের দায়িত্ব সামলান আজহার। তবে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির ঘটনায় আজহারের জায়গায় আবারও অধিনায়কত্ব পান শচীনই। এ ধাপে ১৯ ওডিআই আর ৮ টেস্টে অধিনায়কত্ব করার পর ২০০০ সালে অধিনায়কত্ব হারান সৌরভ গাঙ্গুলির কাছে। বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করা হয়নি শচীনের।
ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় শচীনের নিজের পারফরমেন্স
শচীন অধিনায়কত্বের চাপ নিতে পারতো না? পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাক। নিজের অধিনায়কত্বের ৭৩ ওয়ানডে ম্যাচে শচীনের গড় ৩৭.৭৫ আর পুরো ক্যারিয়ারে ৪৪.৮৩। টেস্টে এটা ৫১.৩৫ আর ৫৩.৭৮। অধিনায়ক হিসেবে শচীনের ২৫ টেস্টে আছে ৭ শতক আর ৭ অর্ধশতক। ৫০.৬৯ স্ট্রাইক রেটে ২০৫৪ রান। তবে ৭৩ ওডিআইতে ৬ শতকের সাথে ১২ অর্ধশতক হয়তো কিছুটা অনিয়মিত পারফরমেন্সেরই বার্তা দেয়।
ওডিআইতে শচীনের এই পারফরমেন্স দেখতে যথেষ্ট ভালোই দেখায় যতক্ষণ না আরও গভীরে ঢুকা হচ্ছে। একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে দেশের মাটিতে এসময়ে শচীনের ওডিআই গড় ৫৭.৭৩ হলেও প্রতিপক্ষের মাটিতে তা মাত্র ২৯.১২। দেশের মাটিতে ১৮ ম্যাচ খেলে শচীনের সংগ্রহ যেখানে ৮৬৬, সেখানে ৮টি অ্যাওয়ে ম্যাচ বেশি খেলেও মোট সংগ্রহ ১৩৮ রান কম। নিউট্রাল ভেন্যুতে ১১ ম্যাচ বেশি খেলে রানটা ৮৬০, ৬ রান তখনো কম। অধিনায়কত্বের চাপটা যে কিছু হলেও ভুগিয়েছে শচীনকে সেটা স্পষ্ট।
এবার আবার শিরোনামে ফেরা যাক। শচীনকে কী সর্বকালের সবথেকে ব্যর্থ অধিনায়ক বলবেন না? না। তবে সবথেকে ব্যর্থ ৫ জনের তালিকা করলে শচীনকে সরাবেন কিভাবে সেই তালিকা থেকে? শচীনের অধীনে ভারতের টেস্ট জয়ের হার মাত্র ১৬ শতাংশ আর ওডিআইতে ৩১.৫। সবথেকে বাজে অধিনায়কদের তালিকা থেকে তাকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করুন তো দেখি, তালিকাটা খালি খালি লাগবে। তবে এই তালিকায় থাকাটা দোষের কিছু না। জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিক, ইংল্যান্ডের ফ্লিনটফ, উইন্ডিজের ব্রায়ান লারাদের মতো কিংবদন্তীরাও আছেন সেই তালিকায়।