ভোরের সূর্য দেখেই না কি আন্দাজ করা যায় দিনটা কেমন যাবে। শচীনের ক্যারিয়ারের শুরুতেও কি তেমন কিছুর পূর্বাভাস ছিলো? কেমন ছিলো শচীনের ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচটি বছর? দেখা যাক।
এরই মধ্যে শচীনের ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ বছরের অনেক কিছু নিয়েই গল্প করা হয়েছে। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করার সোপানের প্রথম পদক্ষেপ, একদিনের ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরতে না পারা, ওপেনার হিসেবে নিজেকে নতুনভাবে প্রমাণ করা, মহাআরাধ্য ওয়ানডে সেঞ্চুরির নাগাল পাওয়া- এ সবই শচীনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ বছরেরই ঘটনা। তবে এ অধ্যায়ে আমরা শচীনের ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ বছরকে আরও একটু বিস্তারিত জানব।
শুরুতে শচীন কেমন ছিলো? অনেকের ভাষ্যমতে শচীনকে শুরুতেই যে পরিমাণে গ্রেট প্লেয়ার বলা হতো, শচীন আসলে তখনো ততোটা ভালো ক্রিকেটার ছিলো না। অনেকের ভাষ্যে, শচীন শুরু থেকেই অনন্য। তর্ক-বিতর্কে আমি আপাতত নেই, আমার লক্ষ্য আপাতত প্রথম পাঁচ বছরে শচীন কী কী করেছিলো তার খানিকটা তুলে ধরা। মূল বিচার-বিশ্লেষণ না হয় আপনারাই করুন।
শুরুর ৫ বছরে শচীন ম্যাচ খেলেছে টেস্টে ৩২টি আর একদিনের ক্রিকেটে ৯০টি। এই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতো আরও অনেক মহারথীরাই। শচীনের নামটা তাদের পরেই থাকতো, শচীন যে শুরু থেকেই গ্রেটেস্ট অন্য দ্যা আর্থ না এমনটা বলাই যায়, শুরুতেই কেউ সেরা হয়ে যায়ও না।
১৯৮৯ এর ১৫ নভেম্বর থেকে ১৯৯৪ এর এই একই তারিখ পর্যন্ত ভারত খেলেছে ৩২ টেস্ট, শচীনও ৩২। এই ৩২ টেস্ট ম্যাচের ৪৫ ইনিংসে শচীন রান করেছিলো ২০২৩ যেখানে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৫০.৫৭। ওই সময়কালে খেলা অন্যান্য ব্যাটারের তুলনায় শচীনের এই গড় মাঝামাঝি রকমের ভালো বলা যায়। এই সময়কালের মধ্যে অন্তত ১০ টেস্ট ইনিংস খেলেছে এমন ব্যাটারদের মধ্যে সেরা গড়ের তালিকায় শচীনের অবস্থান ১৪। ১৩ ইনিংসে ৮০.৪১ গড় নিয়ে বিনোদ কাম্বলির অবস্থান ছিলো সবার শুরুতে। সেই বিনোদ কাম্বলি, যার সাথে শচীন স্কুল ক্রিকেটে গড়েছিলো ৬৬৪ রানের জুটি। ইমরান খান, ব্রায়ান লারা, জিমি এডামসদের অবস্থান ছিলো ২, ৩ এবং ৪-এ।
এই সময়ের মধ্যে সর্বাধিক রান সংগ্রহের তালিকায় শচীনের অবস্থান ১৭তম। শচীনের উপরে থাকা ওই ১৬ জনের মধ্যে শচীনের থেকে (৪৫টি থেকে) কম ইনিংস খেলেছেন শুধু আজহারউদ্দিন (৪৪টি), শচীনের সমান খেলেছেন শুধু সেলিম মালিক আর শচীনের থেকে ১টি ইনিংস বেশি খেলে তার উপরে আছে আরও একজন, তিনি মার্টিন ক্রো। এই সময়ের মধ্যে ব্রায়ান লারা টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ১৬টি, ইনিংস ২৬টি, রান ১৬২৮।
বিশ্ব ক্রিকেট বাদ, শুধু ভারতে আসলে?
ভারতের এই সময়কালে শচীনের সংগ্রহ করা ২০২৩ রানের থেকে বেশি রান ছিলো শুধু মোহাম্মাদ আজহারউদ্দিনের। দুজনের খেলা ম্যাচ সংখ্যা সমান, ইনিংস শচীনের একটি বেশি। আজহারউদ্দিনের মোট রান ছিলো ২১০৮। তিনে সঞ্জয় মাঞ্জেকার শচীনের থেকে ইনিংস খেলেছিলেন ৬টি কম, রানের পার্থক্য ৫৬২। ১৯৯৩তে অভিষেক হওয়া বিনোদকে বাদ দিলে শচীনের গড়ও এ সময়ে ভারত দলের বাকিদের থেকে বেশিই।
একদিনের ক্রিকেটে আসা যাক। ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে এসময়কালে গড়ের দিক থেকে শচীনের অবস্থান চারে। অথচ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শচীনের কোনো ওডিআই শতকই ছিলো না। এই ৫ বছরে শচীনের থেকে ৩ ম্যাচ বেশি খেলেছেন আজহারউদ্দিন। বাকি কেউওই ম্যাচ খেলার সংখ্যায় তাদের আশেপাশেও নেই। তাই মোট সংগ্রহ নিয়ে এখানে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছিনা। বিশ্ব ক্রিকেটে এই সময়ে একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ গড় কার ছিলো? উত্তরটা বাংলাদেশের আথার আলি খান। শ্রীলংকা আর ভারতের বিপক্ষে দুই ম্যাচ খেলে একটায় অপরাজিত থেকে ১২২ গড় নিয়ে সবার উপরে তিনি। ৪ টেস্ট খেলে ২-এ আমিনুল ইসলাম বুলবুল। কমপক্ষে ১০ ইনিংস ব্যাট করেছেন এমন ব্যাটারদের মধ্যে সবার উপরে মাইকেল বেভান, গড় ৫৭.৫০। ৩৫.৯৪ গড় নিয়ে শচীনের অবস্থান ২৩ নাম্বারে।
প্রথম ৫ বছরের পরিসংখ্যান নিয়ে আর কী-ই বা কাটাছেঁড়া করব? পুরো ক্যারিয়ার নিয়ে না হয় শেষে আরেকবার বসবো। আপাতত এই পুরো ৬ বছরে প্রতি বছরান্তে শচীনের পারফরমেন্স আগের থেকে কতটা তীক্ষ্ম বা ভোঁতা হলো তা দেখিয়েই থেমে যাওয়া যাক।
বছর হিসেবে শচীন ১৯৮৯ এবং ১৯৯৪ সালে টেস্ট খেলেছেন ৪টি করে, ১৯৯১ সালে ২টি। ’৯০, ‘৯২তে ৭ টি করে আর ১৯৯৩ তে সর্বোচ্চ ৮ টেস্ট। তবে ইনিংসের বিবেচনায় আবার ১৯৯৩, ১৯৯২ আর ১৯৯০ তে খেলেছেন ৯, ১১ এবং ১০টি। এই ৫ বছরে শচীনের টেস্ট পারফরমেন্স কেমন ছিলো?
সব দিক বিবেচনায় টেস্টে শচীনের সেরা বছর কেটেছে ১৯৯৩; ৯১.৪২ গড়, ২ সেঞ্চুরি, ৫ হাফ সেঞ্চুরিসহ মোট ৬৪০ রান করেছেন শচীন এই বছরের ৯ ইনিংসে। ১৯৯৪ সালটাও শচীনের সেরা টেস্ট বছরগুলোর একটি। বাকি বছরগুলো এভারেজ। ১৯৯১ তে গড় ১৯.৫০, তবে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ২টি অজিদের মাঠে অজিদের বিপক্ষে।
ওয়ানডেতে আবার ১৯৯৩ খুব একটা ভালো যায়নি। ১৮ ম্যাচে ২৪.৫৩ গড়ে মোট সংগ্রহ সর্বসাকুল্যে ৩১৯। এখানে সেরা বছর বলতে হয় ১৯৯৪ কে, যে বছর ওপেন করতে শুরু করেন শচীন সাথে ওয়ানডে সেঞ্চুরিও। ওই দুই মাসেই শচীন নিজের করে নিয়েছিলো ৩টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি; আর ১২ মাসে ২৫ ইনিংস, ৪৭.৩৪ গড়, ১০৮৯ রান। পারফরমেন্স গ্রাফ যুক্ত করে দিলাম।
এটুকু আপাতত বলা যায়, বিশ্ব ক্রিকেটে সে সময় শচীনের থেকেও অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটার ছিলেন, তবে ভারতের সেসময়ের সেরাদের একজনই শচীন। আগমনী বার্তাটা ঠিকঠাকভাবেই দিয়েছিলেন লিটল মাস্টার।
এখন প্রশ্ন তুলতেই পারেন, “এটা কেমন তুলনা হলো?”
আসলেই, এটা কেমন তুলনা হলো। শচীনের ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ বছর নিয়ে যখন কথা বলব তখন তো অন্যান্য গ্রেটদেরও এই প্রথম ৫ বছর নিয়েই আলোচনা করতে হবে। শচীন যেখানে ৫ বছর কোন পজিশনে খেলবেন সেটা ঠিক করতেই গিয়ে শেষ করে ফেলেছেন, সেখানে ততদিনে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারদের সাথে তুলনা করলে কীভাবে হবে? কথা তো সত্য, চলুন দেখা যাক।
শচীনের প্রথম ৫ বছরে ৩২ টেস্ট ম্যাচের ৪৫ ইনিংসে শচীন রান করেছিলেন ২০২৩ যেখানে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৫০.৫৭। ব্রায়ান লারা তার প্রথম ৫ বছরে ৩১ টেস্টের ৫২ ইনিংসে ৬০.৯৬ গড়ে রান করেছিলেন ৩০৪৮। রাহুল দ্রাবিড়ের ছিলো ৭৫ ইনিংসে ৫৩.৮২ গড়ে ৩৬৬০ রান।
ওডিআই দেখা যাক। প্রথম ৫ বছরে লারা ৯২ ম্যাচে রান করেন ৪৪.০৭ গড়ে ৩৭০২, দ্রাবিড় ১৩৪ ইনিংসে ৩৬.৮১ গড়ে ৪৫৬৫। এখানে শচীন করেন ৩৫.৯৪ গড়ে ২৭৬৮ রান। তুলনা করলে আরও অনেকের সাথে করা যায়, কিন্তু প্রয়োজন কী? বুঝা তো যাচ্ছেই যা বুঝার। তবে মাথায় রাখতে হবে দ্রাবিড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলো ২৩ বছর বয়সে, লারা ২১ বছর বয়সে যেখানে অভিষেকের সময় শচীনের ছিলো মাত্র ১৬। এই বয়সেই সেই সময়কার বাঘা বাঘা সব ব্যাটারদের সামালানোর ব্যাপারটা চাট্টিখানি কথা না।
তর্ক-বিতর্ক কী নিয়ে করবেন, কীভাবে করবেন, কেন করবেন- সব আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম। প্রথম ৫ বছরের বোলিং পারফরমেন্স নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি না, তবুও কয়েক লাইন তুলে দিয়েই শেষ করছি।
শচীন অভিষেক ম্যাচ থেকেই বল করতেন। যদিও তা একেবারেই কম। শুরুর টেস্ট বাদ দিলে পরে লম্বা সময় বোলিংয়ে ছিলেন না শচীন। শুরুর ৫ বছরে শচীন ২০ ওভার বল করেছিলেন মাত্র ১ ইনিংসে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, উইকেট পাননি। ২য় সর্বোচ্চ ৫ ওভার। ৫ বছরে টেস্টে ৬৮ ওভার বল করে শচীনের সংগ্রহ ৪ উইকেট, গড় ৪৩, স্ট্রাইক রেট ১০২। আর ওডিআইতে মোট ৩২৯.১ ওভার বল করে উইকেট নিয়েছেন ৩০টি, ৪ উইকেট ১ বার উইন্ডিজের বিপক্ষে পুরো ১০ ওভার বল করে। ওডিআইতে শচীন এই সময়ে মোট ৮ বার পূর্ণ ১০ ওভার বল করেন।