সেপ্টেম্বর ১৯৯৪। নভেম্বর আসলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের ক্যারিয়ার হয়ে যাবে ৫ বছরের। এই ৫ বছরে ৪৫ টেস্ট ইনিংসে ১০টি অর্ধশতক আর ৭টি শতকের সাথে ৫০.৫৭ গড়ে শচীনের মোট সংগ্রহ ২ হাজার ২৩ রান। টেস্টে ততদিনে শচীন প্রমাণ করেছেন নিজেকে, ৬ নাম্বার পজিশন থেকে উঠে এসেছেন টেস্ট দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান ৪ নাম্বারে। কিন্তু ৫০ ওভার ক্রিকেটে হিসেব মিলছিলো না, কি যেন একটার অভাব ছিলো। শচীনের মতো লাগছিলো না, শচীনের নামের পাশে তখন পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেটে কোনো শতক লেখা নেই- বেখাপ্পা লাগার মতো বিষয়ই বটে।
একদিনের ক্রিকেটে শচীনের অভিষেক হয়েছিলো ১৮ ডিসেম্বর ১৯৮৯ পাকিস্তানের বিপক্ষে কার্টেল ওভারের ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় বলে শূন্য রানে আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে। ৩ মাস পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেও একই ফলাফল। প্রথম অর্ধশত রানের দেখা পান শচীন ৯ম ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে। এসময়টাতে তিনি ব্যাট করতেন ৫ নম্বর পজিশনে। ৫ নম্বরে তিনি ব্যাট করেছেন ২৫ অক্টোবর ১৯৯১ পর্যন্ত। ১৯ তম ম্যাচ থেকে নিয়মিত ব্যাট করতে শুরু করেন ৪ নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে। এই পজশনে থেকেও শতকের দেখা পাননি শচীন। বছরখানেক পর আবার ফিরে যেতে হয় পাঁচেই। ৭৮ তম ম্যাচ পর্যন্ত ওডিআইতে শচীন ছিলেন শতকহীন। এই ৭৮ ম্যাচের ৭৫ ইনিংসেই ব্যাট করেছেন শচীন, সর্বোচ্চ রান ৮৪। ৭০ পেরোনো ইনিংস ছিলোই মোটে ৬টি। মোট অর্ধশতকের সংখ্যা তখন পর্যন্ত ১৭। ওই ৭৮ ম্যাচে তার গড় ছিলো ৩২.৭০ যা ক্যারিয়ার শেষে এসে দাঁড়ায় ৪৪.৮৩ এ।
একদিনের ক্রিকেটে কী শচীন নিজেকে মেলে ধরতে পারছে না? না কি শচীন আসলেই টেস্টের মতো একদিনের ক্রিকেটে এতোটা কার্যকর নয়? এসব নিয়ে এই ৫ বছরে লেখালেখি হয়েছে অনেক, লক্ষ কোটি শব্দ খরচ হয়েছে এই এক বিষয়ের উপরেই, শত সহস্র কলম ফুরিয়েছে, খাতা শেষ হয়েছে অগণিত, টাইপরাইটার আর কম্পিউটারের কীবোর্ডেও যে কত সহস্রবার বোতামগুলো চাপা হয়েছে এই এক প্রশ্নের পক্ষে বিপক্ষে তা বলতে গেলেও কীবোর্ডের বোতামগুলো আবার চাপতে হবে তখনকার মতো করেই, তাই সে বিষয়ে আজ যাচ্ছি না। প্রথম ওডিআই শতকের গল্পে ফেরা যাক।
নিজের ক্যারিয়ারের ৭০ তম ম্যাচে গিয়ে শচীন একদিনের ক্রিকেটে ওপেন করেন। তার ওপেনার হয়ে উঠার গল্পও করব খানিক পরে, তবে ওপেনার হয়েই তার সফলতার শুরুটা নিয়ে আগে কথা বলা যাক।
ওপেনিং ব্যাটার হিসেবে শুরু করেই যেন নতুনভাবে জ্বলে উঠলেন শচীন, অদৃশ্য কোনো কিছুর পরশে যেন বদলে গেলো শচীনের ব্যাট। এই পজিশন থেকে শচীনের প্রথম ৫টি ইনিংস ছিলো ৮২, ৬৩, ৪০, ৬৩ এবং ৭৩ রানের। ওপেনার হিসেবে নিজের দশম ম্যাচেই ওডিআই ক্রিকেটের সেই সোনার হরিণ ধরা দিলো শচীনের খাঁচায়। লক্ষ কোটি প্রশ্ন উঠা থামলো তবে এবার। সেই ম্যাচটির গল্পে যাওয়া যাক।
১৯৯৪; সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ নামে শ্রীলংকায় চলছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা আর অস্ট্রেলিয়ার চার জাতি টুর্নামেন্ট। ৯ সেপ্টেম্বর নিজেদের ৩য় ম্যাচে প্রেমাদাসায় অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় ভারত। এদিনই ৫ বছরের আক্ষেপের সমাপ্তি টানেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলো ভারত দল। ওপেন করতে নামলেন শচীনের প্রথম টেস্ট শতকের সময় শচীনকে যোগ্য সঙ্গ দেয়া মনোজ প্রভাকর। ওডিআই ক্রিকেটে একেবারে টেইলেইন্ডার ব্যাটার থেকে মনোজ ওপেনার বনে যান আরও প্রায় বছর দুই আগেই।
অজিদের বিপক্ষের এই ম্যাচেই ১৭৫ মিনিট মাঠে থেকে ১১৯ বলে ৮ চার আর ২ ছয়ের সাথে নিজের প্রথম ওডিআই শতক পান শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। সেঞ্চুরির পর খেলেছিলেন আর ১১ বল; ১৩০ বলে ১১০ রান করে থামে শচীনের সেই ইনিংস আর শুরু হয় ওডিআইতেও নিজের সাম্রাজ্য গড়ার প্রক্রিয়া।
শচীনের প্রথম ওডিআই সেঞ্চুরির পর। Image Source: Navbharat Times |
শচীনের মহাআরাধ্য এই শতকটা কি ফ্লুক? জাস্ট হয়ে গেছে আরকি? এমনটা মনে করা যেতেই পারতো, অনেকে করেও ছিলো। কারণ এই শতকের পরের ৩ ম্যাচেই শচীন আউট হয়েছেন ০ রান করে। পরের ম্যাচে ওয়ান ডাউনে নেমে রান করেছিলেন, শূন্যতে ফিরতে হয়নি, তবে দুই অংকেও পৌঁছাতে পারেননি। এর পরের ম্যাচে আবার ওপেনিংয়ে নেমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেন ১৩৬ বলে ১১৫ রানের ইনিংস। তখন থেকেই শুরু। পঞ্চাশ ওভার ক্রিকেটেও শচীনের সেঞ্চুরি এর পর থেকে নিয়মিতই হচ্ছিলো। ক্যারিয়ার শেষে তার টেস্ট আর ওডিআই শতকের পার্থক্যটা ছিলো মাত্র ২; অথচ এই পরিসংখ্যান দেখে কে বলবে শচীনের প্রথম ওডিআই শতকের আগেই টেস্টে ছিলো সাত-সাতটি শতরানের ইনিংস!