শচীন সেঞ্চুরি করলেই না কি হারতো ভারত?

দোষ নেই, সমালোচনা নেই- এমন কোনো স্পোর্টসম্যান খুঁজে পাবেন? সমালোচনা খুব কম হলেও আছে, থাকবে। কিছু মানুষ থাকবেই সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সামনে আনার জন্য। আনুক, সত্য কথা বলতে দোষ কিসের? তবে যদি তা শুধু হয় অন্যের কথায় শুনে নিজে যাচাই না করে নাচার ব্যাপার, তবে? 

শচীন সেঞ্চুরি করলেই না কি হারতো ভারত?

কবি শামসুর রহমানের লেখা “পণ্ডশ্রম” কবিতার মূলভাবটি বাবার মুখে প্রায়ই শুনি। কবিতাটির শুরুর আর শেষের ৪ লাইন করে ৮ লাইন একটু তুলে দিলাম,

এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,

চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।

কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,

আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

… …

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;

কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।

ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?

বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।


নিজের কান ঠিক জায়গাতেই আছে কি না তা যাচাই করে দেখতে তো খুব বড় কোনো আয়োজনের প্রয়োজন হয় না। তবুও যাচাই না করেই “কান নিয়েছে চিলে” বলে চিলের পেছনে ছুটতে থাকা মানুষদের মতোই ওইসব মানুষ যারা বলে “শচীন সেঞ্চুরি করলেই হারতো ভারত”, ইনারাও কখনোই একটুখানি সময় দিয়ে দেখে না ব্যাপারটি আসলেই কতটা সত্য?


শচীনের আন্তর্জাতিক শতক ১০০টি। এর মধ্যে ৪৯টি একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে আর ৫১টি টেস্টে। এই ১০০ ম্যাচে তো আর ভারত হারেনি, হারবেও না। এই অপবাদ পেতে ১০০ ম্যাচেই হারতে হবে এমন কোনো কথাও নেই। ৭০ ম্যাচ হলেই হয়।

-৭০ ম্যাচ হেরেছিলো?

-না।

-তাহলে ৬০?

-আরে না।

-তাহলে ৫০ তো অন্তত।

-না।

-৪০? 

-না

-৩০?

-না।

শচীনের সেঞ্চুরি করা ১০০ ম্যাচ থেকে ভারত হেরেছিলো মাত্র ২৫টি। ৪৯ ওডিআই সেঞ্চুরির ১৪টিতে আর ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরির ১১টিতে। শচীন এক টেস্টে ২ সেঞ্চুরি কখনো করেননি, তাই ৫১ সেঞ্চুরি মানে ৫১টি টেস্ট ম্যাচ। 


এই আলোচনা তো এখানেই থেমে যেতে পারে, আরও সামনে বাড়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়? আমার মনে হয় না, তবুও অন্ধের মতো এই বুলি আওড়ানো মানুষেরাতো আর এতটুকুতে দমে যাবে না, একের পর এক ফেলনা যুক্তি সামনে নিয়ে হাজির হবেই।

শচীনের সেঞ্চুরি করা ২৫ ম্যাচে ভারত দল কেন হেরেছিলো? শচীনের সেঞ্চুরির জন্য? শচীন সেঞ্চুরি করার দিকে বেশি মন দিয়েছে দলের ভালোর থেকে? 

হেরে যাওয়া ম্যাচ গুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যাবে ঠিক কেন হেরেছে শচীন। এক এক করে সব ম্যাচ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছিনা। অল্প কিছু বলা যাক।


১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে হারের কারণ ছিলো শচীন আর আজহার ছাড়া অন্য কারো ব্যাট হাতে কিছু করতে না পারা, একই বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে হেরেছিলো দলের বাকি সব ব্যাটারদের ব্যর্থতায়। আগস্টে আবার সেই শ্রীলংকার বিপক্ষে হার। এবার ধীরে খেলার প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ, শচীন এবার ১১০ রান করেছেন ১৩৮ বল খেলে। তবে এই ম্যাচের আরেক ওপেনার অজয় ৯ বলে ০, সৌরভ ৪১ বলে ১৬, আজহার ৯৯ বলে ৫৮ করেন। দোষটা কি আসলেই এক শচীনের উপরই দেয়া যায়?

পরের হারটা ২ বছর পর, ১৯৯৮ সালে, শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার করা ২৮৫ রান রিভাইসড টার্গেটে আসে ৪৬ ওভারে ২৭৭। ৪৬ ওভার মানে ২৭৬ বল। এই ২৭৬ বলের মধ্য থেকে ১৩১টি খেলেছেন শচীন। এই ১৩১ বলে শচীন রানও করেন ১৪৩। শচীন ছাড়া বাকি সবার স্কোর? ১৭, ৩৫, ১৪, ১, ২৩* (৩৪), ৫* (১৪) । শচীন আউট হয় দলীয় রান ২৪২ এ রেখে। তখনও ৩ ওভার বাকি, রান প্রয়োজন ৩৪। এই ৩ ওভারে বাকি ব্যাটাররা রান করেছিলো মাত্র ৮। ম্যাচ হারের দায় শচীনের?


এভাবে খুঁজতে থাকলেই দেখা যাবে শচীনের সেঞ্চুরি করা যে ২৫% ম্যাচে হেরেছে ভারত, সেখানে দোষ শচীনের না কিংবা শচীনের একার না। টেস্টে ব্যাপারটা আরও বেশি স্পষ্ট। ম্যাচ বাই ম্যাচ নিয়ে বলা আর সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের সাথে শচীনের শেষ সেঞ্চুরির দিনেও হারে শচীনরা, সেদিনের ম্যাচ নিয়ে কিছুটা বলে পরিসংখ্যানে যাওয়া যাক।

এশিয়া কাপের সেই আসরে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে ২১ রানে হারিয়ে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাংলাদেশীরা। সেই আসরে শ্রীলংকাকেও বৃষ্টি আইনে তুলনামূলক কঠিন সমীকরণে ৫ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। সেই আসরের বাংলাদেশ আর ভারতের উভয়েরই দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয় একে অপরের। প্রথমে ব্যাট করে ভারত দল করে ২৮৯ রান। ডিফেন্ড করার জন্য রানটা যথেষ্ট হলেও সমালোচনা ঠিকই ছিলো শচীনকে নিয়ে। শচীন সেদিন সত্যিই স্লো ব্যাটিং করেন। ১৪৭ বলে করেন ১১৪ রান। সেঞ্চুরির আগের ১৩ রান করতে শচীন খেলেন ২৩ বল। তবে এটাই কী শুধু সেদিনের হারের কারণ? 

ভারতীয় বোলাররা যে বাংলাদেশী ব্যাটারদের সামনে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি সেটা দেখা হবে না? তামিম ইকবালের ৭০, জহুরুল ইসলামের ৫৩, নাসির হোসেনের ৫৪, সাকিব আল হাসানের ৪৯ আর মুশফিকুর রহিমের ৪৬; প্রত্যেকেই তো ব্যাট হাতে জ্বলেছেন। এক নাজিমুদ্দিন ছাড়া সেদিন কোনো বাংলাদেশি ব্যাটারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি ভারতীয় বোলাররা। ইরফান পাঠান, অশোক দিন্দাদের ইকোনোমি ছিলো সেদিন ৬.৭৭ আর ৭.১২। শচীনের স্লো ব্যাটিংকে দোষী করতে চাইলেও বোলারদের সেফ জোনে রাখার কোনো উপায় নেই। তার চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের প্রত্যেক ব্যাটারই সেদিন ভালো ব্যাট করেছে…


এবার অন্য কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক।

হ্যাঁ, এটা সত্য যে হারা ম্যাচে সবথেকে বেশি সেঞ্চুরি শচীনের। হওয়াটাই কি স্বাভাবিক না? সবথেকে বেশি শতক যার থাকবে, হারা ম্যাচেও তার শতক সবথেকে বেশি থাকতেই পারে। তাই এক্ষেত্রে এতো ম্যাচে এতো হার হলে, একশো ম্যাচে কত?- হিসেবে নিয়ে দেখা যাক। 


শচীনের ১০০ শতকের মধ্যে ২৫টিতে দল হেরেছে, শতকরার হিসাবে ২৫%। অন্যদিকে ব্রায়ান লারার ক্যারিয়ারে মোট আন্তর্জাতিক শতক ৫৩টি যার মধ্যে ১৭টিই হারা ম্যাচে। এক্ষেত্রে শতকরার হিসাবটা ৩২.০৮%। এর বাইরেও উইন্ডিজ আরেক ক্রিকেটার চন্দরপালের ৪৭টি সেঞ্চুরির মধ্যে হারা ম্যাচে ১৩টি, শতকরা ২৭.৬৬ শতাংশ। ক্রিস গেইলের ৪২ সেঞ্চুরির মধ্যে ১৫টি হারা ম্যাচে, শতকরার হিসেবে ৩৫.৭১%। পরাজিত ম্যাচে শতকের তালিকার মতোই পরাজিত টেস্টেও ব্রায়ান লারা শচীনের উপরে। এখানে আমি শচীনের পক্ষে বলতে গিয়ে লারার বিপক্ষে বলছি- ব্যাপারটা এমন না। শুধু স্ট্যাটটা তুলে ধরলাম। পরাজিত ম্যাচে বেশি সেঞ্চুরি করাটা তাদের কারোই দোষ না।


সেঞ্চুরি করার পেছনের কারণ নিজের যোগ্যতা, দলের জেতার পেছনের কারণ দল হিসেবে খেলতে পারে পারা। এতো এতো ম্যাচের মধ্যে সব ম্যাচেই কী দলের সবাই সমানভাবে ভালো খেলবে? ব্যাপারটা অসম্ভব। দলগত খারাপ পারফরমেন্সে দল হারলে সেটা শচীনের সেঞ্চুরির উপর টেনে এনে ফেলাটা নিছক বোকামি। টানাটানি ছিলো, আছে, থাকলে থাকুক। আপাতত আমি এই লেখা এখানেই থামাচ্ছি। 


ও হ্যাঁ, শচীনের করা ১০০ আন্তর্জাতিক শতকের মধ্যে ৫৩ ম্যাচ ভারত জিতেছে, ২৫টি হেরেছে। বাকিগুলোর মধ্য থেকে ২০ টি টেস্ট ম্যাচ ড্র হয়েছে যা ক্ষেত্রবিশেষ জয়ের থেকে কম না। বাকি দুটি ম্যাচের একটিতে কোনো ফলাফল আসেনি, অন্যটি টাই।

এই লেখাটি পাঠগৃহ নেটওয়ার্কের 'মোঃ রবিউল মোল্লা'র লেখা "শচীন রমেশ: এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য" নামক ই-বুকের অংশ।
শচীনের কতটি সেঞ্চুরি করা ম্যাচে ভারত হেরেছে?
Md. Rabiul Mollah

Okay! So here I'm Md. Rabiul Mollah from Pathgriho Network. I'm currently a student of B.Sc in Textile Engineering Management at Bangladesh University of Textiles. facebook instagram github twitter linkedin

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺