সব উপন্যাসেরই শেষ আছে, মহাকাব্যেরও ইতি টানতে হয়; ২৪ বছরের ক্যারিয়ারও শেষ করতে হবে শচীন রমেশ টেন্ডুলকারকে। ঘোষণা দিলেন, নিজের ২০০তম টেস্ট ম্যাচই হবে তার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের শেষ ক্রিকেট ম্যাচ। ব্যস, শুরু হলো আরেক হুলস্থূল কাণ্ড। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের জায়গা করে দেয়া থেকে যার শুরু, ভক্তদের জটলা, “শচীন... শচীন...” বলে গগনবিদারী চিৎকার, সুধীর গৌতমের শঙ্খ বাজিয়ে যাওয়া; এই সব কিছুই তাকে বিদায় জানাতে।
এই ইবুকটি শুরুই করেছিলাম শেষ দিনের বর্ণনা দিয়ে। তখন ওসব বলার কারণ ছিলো শচীন নামের কলেবর বুঝানো, যাতে পুরো লেখায় আমার করা ভুলভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারেন। এখন আবার সেই একই কথাগুলোই বলবো। এবারের কারণ, শচীনের বিদায়ের দিন নিয়ে বার বার নতুন করে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই।
১৪ নভেম্বর ২০১৩, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ ম্যাচ শচীনের টেস্ট ক্যারিয়ারের ২০০তম ম্যাচ, এ ম্যাচ শচীনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এ ম্যাচে টস জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠালো মাহেন্দ্র সিং ধোনি্র দল। ৫৫.২ ওভার খেলতেই ১৮২ রানে উইন্ডিজরা হারিয়ে ফেলে সবগুলো উইকেট। জবাবে মুরালি বিজয় আর শিখর ধাওয়ান দুজনেই দলীয় ৭৭ রানে ফিরে গেলে পুজারার সাথে ক্রিজে আসেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। প্রথম দিন শেষে শচীন ৩৮ রানে অপরাজিত থেকে নামেন দ্বিতীয় দিন।
শচীন যখন ওই ইনিংসে পরের দিন তথা শেষবার ক্রিজে ব্যাট হাতে নামেন, ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন তারিখ ১৫ নভেম্বর, ঠিক ২৪ বছর আগের এই দিনটাতেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অভিষেক হয়েছিলো শচীনের।
নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ইনিংসে ৯১ বলে নিজের শেষ অর্ধশতক তুলে নেন শচীন। ১১৮ বল থেকে ৭৪ রান করে শচীন স্লিপে থাকা ড্যারেন স্যামির হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে স্যামিকে অশ্রুসিক্ত করে শেষ করেন ব্যাটার হিসেবে নিজের যাত্রা। দিন শেষ হয় ভারতের ৪৯৫/১০ এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪৩/৩ তে। বুঝাই যাচ্ছিলো ম্যাচটা পরদিনই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সাথে শচীনের ২৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাও। শচীনের ২৪ বছরের ক্যারিয়ারটা বন্ধ হয় নরসিং ডিওনারিনের বলে।
১৬ই নভেম্বর ২০১৩, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরে গণমানুষের জটলা, কারণটা ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সম্রাটের বিদায়, কারণটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের বিদায়, কারণটা একশোটি আন্তর্জাতিক শতকের মালিকের বিদায়, কারণটা ২৪ বছরের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ার সেদিনই শেষ করতে চলেছেন ক্রিকেটের বরপুত্র, ক্রিকেট পাড়ার শিরোমণি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।
পুরো ক্রিকেট বিশ্ব সেদিন আনন্দ-অশ্রু নিয়ে বসে ছিলো টিভি সেটের সামনে, এ যেন এক মহাকাব্যের শেষ, শেষটার সাক্ষী যে আমাকে হতেই হবে- এমনটাই ভাবনাতে ছিলো সেদিন পুরো ক্রিকেট বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীদের।
কেবল যে স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরেই সমর্থকের ভিড় জমেছে তেমনটি কিন্তু না। স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকে সামলাতে হয়েছে প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের জায়গা করে দেয়ার চ্যালেঞ্জও। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক, এ তো আর পাঁচজন ক্রিকেটারের বিদায় না, সম্রাটের বিদায়, একটি সাম্রাজ্যের শেষ, খবর সংগ্রহ করার বাহানায় সেই দিনটার সাক্ষী হতে আসা এতো এতো সাংবাদিকদের প্রেসবক্সে জায়গা করে দিবেই বা কীভাবে?
বিদায়। (Image Source: BCCI) |
যাই হোক, ম্যাচ শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগেনি। ১৮৭ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অলআউট হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেলো শচীন রমেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার, শেষ হয়ে গেলো সাম্রাজ্যের আরও বিস্তৃতি ঘটার, ক্রিকেট হারালো তার সম্রাটকে। সময়ের হিসাবে টেস্ট ইতিহাসের ৫ম লম্বা ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তিও ঘটে গেলো। বিদায় শচীন, বিদায়!