ডিসেম্বর ১৯৮৯তে শুরু, আরেক ডিসেম্বরেই অবসরের ঘোষণা। মাঝের এতোগুলো বছর ক্রিকেটের এই সংস্করণে রঙিন পোশাকে প্রতিপক্ষের বোলার-ফিল্ডারদের সাদাকালো করে নিজের ক্যারিয়ারকে করে গেছেন রঙিন। কেমন ছিলো শচীনের সম্পূর্ণ ওডিআই ক্যারিয়ার? এ নিয়েই কিছুটা কাটাছেঁড়া করা যাক।
সাধারণ দৃষ্টিতে আপনি যদি তাকান তবে দেখবেন শচীন মোট একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন ৪৬৩টি, শতক ৪৯টি, অর্ধশতক ৯৬টি আর মোট রান ১৮ হাজার ৪২৬। ভালোভাবে তাকালেই দেখবেন ওডিআই ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ৪৬৩ ম্যাচের বেশি ম্যাচ কেউ খেলেনি, ৪৯টি শতক কিংবা ৯৬টি অর্ধশতকের বেশি কেউ করেনি, সাথে ১৮,৪২৬ রানের বেশিও কেউ করতে পারেনি। সব দিক থেকেই শচীন সবার উপরে।
শচীনের খেলা ৪৬৩ ম্যাচের পর দুইয়ে থাকা জয়বার্ধন ম্যাচ খেলেছেন ৪৪৮টি। সেরা ৫ এর বাকি ৩ জন সনাৎ জয়সুরিয়া, কুমার সাঙ্গাকারা এবং শহীদ আফ্রিদি।
শচীনের ১৮ হাজার রানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক কুমার সাঙ্গাকারা, সেটাও ৪ হাজার কম। শচীনের ওডিআই ক্যারিয়ারের ৪৯টি সেঞ্চুরির পর ২য় সর্বোচ্চ ৪৩টি সেঞ্চুরি আছে ভিরাট কোহলির।
৯৩ অর্ধশতক আর ১১৮টি ৫০+ রানের ইনিংস নিয়ে কুমার সাঙ্গাকারা আছেন সর্বোচ্চ অর্ধশতক আর ৫০+ রানের ইনিংসের তালিকার ২য় স্থানে।
শচীনের এই ৯৬টি অর্ধশত রানের ইনিংসের মধ্যে ১৮টি ৯০ এর উপরে। ৯০ এর বেশি কিন্তু ১০০ এর কম এমন ইনিংসের সংখ্যাও শচীনেরই সবথেকে বেশি। এর মধ্যে ২০০৭ সালেই ৩ বার আউট হয়েছেন ৯৯ রানে।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে শচীনের নামের পাশে আছে ১৫৪ উইকেট। ক্রিকেটের এই সংস্করণে ১৫০ উইকেট আর ৩০০০ রানের মালিক যে ১৯ জন তাদের মধ্যে শচীন একজন। এক সিরিজে ২৫০ রানের সাথে ১০ উইকেটের শিকারের ঘটনা ঘটেছে ৩২ বার, তার মধ্যে আছে শচীনের নামটাও। ক্যারিয়ারে ১ হাজার রান, ১৫০ উইকেট আর ৫০ ক্যাচের রেকর্ড তালিকাতেও নাম আছে শচীনের।
শচীনের করা ২০০ রানের ইনিংসটি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ইতিহাসের ৮ম সর্বোচ্চ ইনিংস। ১৯৯৮ সালে করা ১৮৯৪ রান এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সর্বোচ্চ রান। ১৯৯৬তে তার করা ১৬১১ রানও আছে এই তালিকার ৪র্থ স্থানে। অধিনায়ক হিসেবে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের তালিকায় ১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ১৮৬* রানের ইনিংসটিও আছে ৪ নম্বরে।
ওডিআইতে সর্বোচ্চ শতকের মালিক শচীন এক ক্যালেন্ডার ইয়ারেও করেছেন সর্বোচ্চ ৯টি শতক। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯ শতক করে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সর্বোচ্চ শতকের তালিকাতেও সবার উপরে শচীন, একই সাথে আছে ভিরাট কোহলি, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
শচীন তার ক্যারিয়ারে মোট ১৫ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেছেন। এদের মধ্যে সবথেকে বেশি ৮৪ ম্যাচ খেলেছেন শ্রীলংকার বিপক্ষে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১ ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৯ ম্যাচ পাকিস্তানের বিপক্ষে। অন্তত ১০ ম্যাচ খেলেছেন এমন প্রতিপক্ষদের মধ্য থেকে সবথেকে বেশী গড় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (৫২.৪৩) আর সবথেকে কম গড় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে (৩৫.৭৩)। একই শর্তে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট কেনিয়ার বিপক্ষে (৯৭.০০),দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে (৯৫.৩৬) ।
দেশ হিসাব করলে শচীন সবথেকে বেশি ম্যাচ তো অবশ্যই নিজ দেশে খেলেছেন। ভারতের পর সবথেকে বেশি ম্যাচ খেলেছে অস্ট্রেলিয়ায় (৪৭), শ্রীলংকায় (৪৪), আরব আমিরাতে (৪২) । তবে গড়ের দিক থেকে সবথেকে সফল জিম্বাবুয়ের মাটিতে। সেখানে ১১ ম্যাচে শচীনের গড় ৮১.৮৫ যেখানে নট আউট ছিলেন ৪ বার। কোনোবার নট আউট না থেকে সর্বোচ্চ গড় বাংলাদেশের বিপক্ষে, ১৬ ম্যাচে গড় ৫১.৬৮। পাকিস্তান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শচীনের ওডিআই গড় সবথেকে কম।
এশিয়ার বাইরে আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা আর ওশেনিয়ায় খেলা ম্যাচগুলোর মধ্যে আফ্রিকা আর ইউরোপে শচীন ভালোভাবেই সফল। আফ্রিকায় ৫৫ ম্যাচে ৪৪.৮৩ গড়ে শচীনের মোট সংগ্রহ ২১৯৭ রান আর ইউরোপে ৩০ ম্যাচে ৪৪.৮২ গড়ে সংগ্রহ ১২৫৫ রান। এশিয়ার মাটিতে এই গড়টা ৪৭.৩২ আর ওশেনিয়ায় সেটা সবথেকে কম, ৬৯ ম্যাচ খেলে ৩৬.১২ গড়ে সংগ্রহটা ২৩১২।
হোম, অ্যাওয়ে আর নিউট্রাল- সবখানেই যথেষ্ট ভালো শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তবুও বাকি দুইয়ের থেকে অ্যাওয়ে ম্যাচে অনেক বেশিই পিছিয়ে। শচীন এমন একজন ক্রিকেটার যিনি মোট ৯ জন অধিনায়কের অধিনায়কত্বে খেলেছেন আবার নিজেও অধিনায়কত্ব করেছেন। এতোসব অধিনায়কদের ভিড়ে নিজের ক্যাপ্টেন্সিতে পারফরমেন্স গাঙ্গুলি, ধোনি, আজহার, দ্রাবিড় আর শেবাগদের ক্যাপ্টেন্সিতে করা পারফর্মের থেকে বাজে; অধিনায়কত্বের চাপ আর হারের বৃত্ত ভেদ করতে না পারার চিন্তাই হয়তো আসল কারণ। বিশ্বকাপ আর এশিয়া কাপে শচীনের গড় ৫৬.৯৫ আর ৫১.১০।
শচীনের দুর্বলতা ছিলো কোন ধরনের বোলারদের বিপক্ষে?
শচীনের ক্যারিয়ারের ৪৬৩ ম্যাচে ব্যাট হাতে নেমেছিলেন ৪৫২ ম্যাচে। এর মধ্যে ৪১ ম্যাচে আউট হননি। বাকি যে ৪১১ বার আউট হয়েছেন শচীন, তার মধ্যে ৩০০ বারই পেসারদের বিপক্ষে। এর মধ্যে আবার ২৬৩ বারই ডান হাতিপেস বলারদের কাছেই উইকেট খুইয়েঁছেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ০ থেকে ৯ রানের মধ্যেই আউট হয়ে গেছেন ১২২ বার, সংখ্যাটা মোটেও কম না। শচীন হিট উইকেট আউট হয়েছেন একবার, স্টাম্পড হয়েছেন ১১ বার, রান আউট হয়েছেন ৩৪ বার, এলবিডব্লিউ হয়েছেন ৩৯ বার। বাকিগুলো থেকে বোল্ড হয়েছেন ৬৮ বার, উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন ৭২ বার আর বাদ-বাকি ১৮৬ বারই বারই আউট হয়েছেন অন্য কোনো ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে।
Image Source: ESPNCricinfo |
চামিন্দা ভাস, ব্রেট লি আর শন পোলকের বলে আউট হয়েছেন ৯ বার করে মোট ২৭ বার। ফিল্ডার হিসেবে ক্যাচ ধরে শচীনকে সবথেকে বেশি বার আউট করেছেন রিকি পন্টিং (৫ বার) আর উইকেটকিপার হিসেবে ৯ ক্যাচ আর ১ স্টাম্পিংয়ে শচীনকে সাজঘরে ফেরানোর কাজে সবার উপরে আছেন অ্যাডাম গ্রিলক্রিস্ট। ওডিআই ক্যারিয়ারে শেষবার শচীন আউট হন সাঈদ আজমলের বলে ইউনিস খানের হাতে ক্যাচ দিয়ে আর তার আগের ম্যাচে মাশরাফি বিন মর্তুজার বলে তামিম ইকবালের হাতে ক্যাচ দিয়ে। শচীনের ওডিআই ক্যারিয়ার ওই এশিয়া কাপেই শেষ।
২০১২ এর এশিয়া কাপের পর একটা সিরিজ খেলেছে ভারত যেখানে শচীন ছিলেন না। ওই বছরেরই ১২ই ডিসেম্বর বিসিসিআইয়ের মাধ্যমে শচীন জানান ২০১৫ বিশ্বকাপের জন্য তরুণদের নিয়ে দল গুছাতে একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন তিনি। সাম্রাজ্যের একাংশের আরও বিস্তৃতি লাভও সেখানেই থামে…
এই লেখাটি পাঠগৃহ নেটওয়ার্কের 'মোঃ রবিউল মোল্লা'র লেখা "শচীন রমেশ: এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য" নামক ই-বুকের অংশ।
শচীনের ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনালের সকল পরিসংখ্যান নিয়ে কাটাছেঁড়ার চেষ্টা!
Tags:
Sachin