'৯২, ’৯৬, ’৯৯, ‘২০০৩, ’০৭ – পাঁচ পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছে ফেলেছেন শচীন। বিশ্বকাপটা তখনো অধরাই রয়ে গেছিলো ক্রিকেটের এই বরপুত্রের। টি২০ খেলেছেনই এক ম্যাচ, তাই টি২০ বিশ্বকাপ ভারতের দখলে গেলেও সেখানে শচীন তো ছিলেন না। তবে খালি হাতে অবসরে যেতে হয়নি, নিজেদের মাটিতে হওয়া ২০১১ বিশ্বকাপটা তুলে ধরার ভাগ্যটা ঠিকই হয়েছিলো এই মাস্টার ব্লাস্টারের। নিজের ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপে ঠিকই ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিলেন অধরা সেই বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে শচীনের কিছু ঘটনা আর পরিসংখ্যান নিয়েই এই অধ্যায়।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পার্থে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন শচীন। প্রথম ম্যাচে ৪৪ বলে ৩৫ রানের ইনিংস খেলে আউট হন শচীন, দলও হারে ৯ উইকেটে। পরের ম্যাচে ব্যাট হাতে নামা হয়নি, তারপরের ম্যাচে ১১ করেই ফিরতে হয়।
বিশ্বকাপের মঞ্চেও জ্বলে ওঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি শচীনের। মাত্র ৩ ম্যাচ আর ২ ইনিংস পরই সিডনিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ৫৪ রানের ইনিংস। ম্যাচ জিতে ইন্ডিয়া আর ম্যাচ সেরার পুরষ্কার জিতেন শচীন। পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮১ রান, এরপরের এক ম্যাচ বাদ দিয়ে পরের ম্যাচে আবারও ৮৪। ৮ ম্যাচে ৩ অর্ধশতক নিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ ভালোভাবেই পার করেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।
পরের বিশ্বকাপতো ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের দিক দিয়ে নিজেরই করে নিয়েছিলেন শচীন। শুরুটাই করেছিলেন কেনিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংস দিয়ে। পরের ৩ ম্যাচে ৭০, ৯০ আর ১৩৭। সেবারের বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচ খেলে ৫২৩ রান নিয়ে সবার উপরে ছিলেন শচীন। গড়টা রীতিমত ভয়ংকর, একেবারে ৮৭.১৬। অবশ্য ১ ম্যাচ কম খেলে ৩ নম্বরে থাকা শ্রীলংকার অরবিন্দ ডি সিলভার গড় ছিলো ৮৯.৬০। সেবারের বিশ্বকাপে শচীনের ছিলো ২টি শত আর ৩টি অর্ধশত রানের ইনিংস।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ, শচীনের জন্য এটি একটু আলাদা। একটু না, অনেকখানিই আলাদা হতে পারতো। হতে পারতো শচীন বিশ্বকাপ থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে, হতে পারতো খেলে গেছেন তবে মনোযোগটা ছিলো না। কোনোটাই হয়নি। তবে এসব হতে পারতো এমন কিছু একটা ঠিকই হয়েছিলো।
ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৯৯৯ বিশ্বকাপটা শচীন শুরু করেন ব্যাক ইনজুরি নিয়ে। না, উপরে যেসব বললাম সেগুলোর পেছনের ঘটনা এটা না। ইনজুরি দমিয়ে রাখতে পারেনি শচীনকে, যদিও স্বাচ্ছন্দে খেলতে পারছিলেন না, তবুও।
’৯৯ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে, ২৮ রানের ছোট্ট ইনিংস। পরের ম্যাচের আগে ১৮ই মে কিছু একটা ঘটলো। বিশ্বকাপের শুরুতে ভাই অজিত ইংল্যান্ডে থাকলেও ততক্ষণে ফিরে গেছেন ভারতে। শচীনের সহধর্মীনি অঞ্জলিকে অজয় ফোনে জানালো সেই ঘটে যাওয়া ব্যাপারটি। অঞ্জলিকে বলা হলো শচীনকে জানাতে। অঞ্জলি তখন লন্ডনে, আর দল লেস্টারে।
অঞ্জলি ফোনে এই খবর প্রথমে জানালো ভারত দলের দুই ক্রিকেটার রবিন সিং আর অজয় জাদেজাকে। তাদের বললো অঞ্জলি যখন লন্ডন থেকে লেস্টারে পৌঁছাবে তখন তারা দুইজন যেন শচীনের রুমের বাইরেই থাকে। হোটেল ম্যানেজারকে ফোন করে জানিয়েছিলো শচীন যেন কোনো ফোন কল না পান এই সময়টুকুতে। শচীন তখন পরদিনের জিম্বাবুয়ের বিপক্ষের ম্যাচের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মাঝরাতে শচীনের দরজার সামনে রবিন, জাদেজা আর লন্ডনে থাকা অঞ্জলি- শচীনের বুঝতে দেড়ি হলো না বড়সড় কিছু একটা হয়েছে।
“শচীনের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন,” রাত পোহালেই যেখানে বিশ্বকাপে নিজেদের ২য় ম্যাচ, সেখানে মাঝরাতে এমন খবর। স্থবির হয়ে যাওয়া শচীন চলে গেলেন ভারতে। শোককে পেছনে ফেলে আবার ফিরেও এলেন বিশ্বকাপে, গিয়েই কেনিয়ার বিপক্ষে খেলেন বিশ্বকাপে শচীনের এখন পর্যন্ত ২য় সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংস। এই বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো ভালো যায়নি শচীনের। ব্যাক ইনজুরির সাথে বাবা হারানোর শোক; ২, ২২, ০, ৪৫, ১৬- তার বাকি ম্যাচগুলোর স্কোর।
- এতো শুধু ঘটনাপ্রবাহ। পরিসংখ্যান কোথায়? শচীন বিশ্বকাপে কেমন ছিলো?
শচীন টেন্ডুলকার এক মাত্র ক্রিকেটার যার বিশ্বকাপে ২০০০ রানের বেশি রান আছে। ২২৭৮ রান নিয়ে শচীন এখানে সবার উপরে। তার থেকে এক ম্যাচ বেশি খেলা রিকি পন্টিংয়ের সংগ্রহ ১৭৪৩। ৮ ম্যাচ কম খেলে ৭৪৬ রান পেছনে থেকে ৩ নাম্বার নামটা লংকান গ্রেট কুমার সাঙ্গাকারার। বিশ্বকাপে অন্তত ১ হাজার রান আছে এমন প্লেয়ারদের মধ্যে শচীনের থেকে বেশি গড়ের মালিক শুধু এবিডি ভিলিয়ার্স আর ভিভ রিচার্ডস।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবথেকে বেশি ম্যাচ কে খেলেছেন? ৪৬ ম্যাচ রিকি পন্টিং আর তার পরই আছেন ৪৫ ম্যাচ খেলা শচীন রমেশ সাম্রাজ্য।
ওডিআই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ শতকের মালিক শচীন আর রোহিত। শচীনের ম্যাচ সংখ্যা ৪৫ আর রোহিতের ১৭। সর্বোচ্চ অর্ধশতকের তালিকায় শচীনের আশেপাশে কেউ নেই। শচীনের ১৫টি অর্ধশতকের পর ২য় সর্বোচ্চ ১০ অর্ধশতকের মালিক বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। ৫০+ ইনিংসেও অবশ্যই শচীন সবার উপরে। শচীনের পরের নাম দুটো সাকিব আল হাসান আর কুমার সাঙ্গাকারার, দুজনেরই ৫০+ রানের ইনিংস আছে ১২টি করে।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে শচীন ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, একই ব্যাপার ঘটেছে ২০০৩ বিশ্বকাপেও। ১১ ম্যাচে ৬১.১৮ গড়ে ৬৭৩ রান নিয়ে সবার উপরে ছিলেন শচীন। ২-য়ে থাকা সৌরভ গাঙ্গুলি সমান সংখ্যক ম্যাচ খেলে সংগ্রহ করেছিলেন ৪৬৫ রান। বিশ্বকাপের সকল সংস্করণ মিলিয়ে কোনো এক আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকাতেও শচীনের উপরে কেউ নেই। ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীনের এই ৬৭৩ রানের পর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ২০০৭ বিশ্বকাপে ম্যাথু হেইডেনের ৬৫৯ রান। তালিকার বাকি তিনজনই ২০১৯ বিশ্বকাপের, ম্যাচ সংখ্যা সবারই শচীনের থেকে কম। এই ৩ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৬.৫৭ গড়ে মোট ৮ ম্যাচ থেকে ৬০৬ রান নিয়ে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান আছেন ৫ নম্বরে।
শচীন শত রান করলেই না কি দল হারে? এমন একটা অপবাদ তার নামে এখনো আছে। এ বিষয়েও আলাদাভাবে লিখব কিছু, তবে আপাতত দেখা যাক বিশ্বকাপে দলের জয়ী ম্যাচে শচীন কেমন?
শচীন এখানেও সবার সেরা। ৬৫.৯১ গড়ে ১৫১৬ রান নিয়ে ১ নাম্বারে আছেন শচীন। বিশ্বকাপের নকআউটে শচীন খেলেছেন ৭ ম্যাচ, সেখানে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় আছেন ৩ নাম্বারে।
বিশ্বকাপ হাতে শচীন টেন্ডুলকার। (Image Source: ICC) |
শচীনের খেলা ছয়-ছয়টি বিশ্বকাপের ৪৫ ম্যাচের ৪৪ ইনিংসে তিনি যেসব কীর্তি গড়েছেন, তারই কিছু উল্লেখের চেষ্টা করেছি। এই ৬ বিশ্বকাপে শচীন ৯ বার পেয়েছেন ম্যাচ সেরার পুরষ্কার যা এই তালিকাতেও সবার উপরে রেখেছে শচীনের নাম। এতো এতো রেকর্ড যার, তার হাতে একটি বিশ্বকাপ না থাকলে তো বেমানান হতোই বিষয়টা, ফুটবলে যে ব্যাপারটা এ যুগের মেসি-রোনালদোর ক্ষেত্রে হচ্ছে। ২০১১ বিশ্বকাপটা তার জন্যই হয়তো জিতেছে ভারত, সেরার মুকুটে আরও এক বর্ণিল পালক, শচীন নামক ক্রিকেট সাম্রাজ্যের আরও অনেকটা নব বিস্তৃতি হয়েই আছে ২০১১ এর আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ।