শচীন সাম্রাজ্যের নেপথ্যে

১৬ই নভেম্বর ২০১৩, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে চলছে ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ২য় টেস্টের ৩য় দিন; ম্যাচটা শেষ হয়ে যাবে সেদিনই এটা অনেকটাই নিশ্চিত। তাই তো স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরে গণমানুষের জটলা। না, সে ম্যাচে বিশেষ কোনো রেকর্ড হচ্ছিলো না যার কারণে এতো ক্রিকেট সমর্থককে ভিড় করতে হবে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের ভেতরে-বাহিরে।

কারণটা অন্য, কারণটা ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সম্রাটের বিদায়, কারণটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের বিদায়, কারণটা একশোটি আন্তর্জাতিক শতকের মালিকের বিদায়, কারণটা ২৪ বছরের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ার সেদিনই শেষ করতে চলেছেন ক্রিকেটের বরপুত্র, ক্রিকেট পাড়ার শিরোমণি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তাই তো 'শচীন' 'শচীন' বলে গগনবিদারী চিৎকারে সেদিন মুখোরিত ছিলো মুম্বাইয়ের সাথে সাথে পুরো ভারতের ট্রপোস্ফেয়ার। পুরো ক্রিকেট বিশ্ব সেদিন আনন্দ-অশ্রু নিয়ে বসে ছিলো টিভি সেটের সামনে, এ যেন এক মহাকাব্যের শেষ! শেষটার সাক্ষী যে আমাকে হতেই হবে- এমনটাই ভাবনাতে ছিলো সেদিন পুরো ক্রিকেট বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীদের। তাই তো সেদিন জ্বরের বাহানা দিয়ে আমিও শুয়ে ছিলাম টিভিটা অন করে, ওই একটা দিনের জন্য স্কুল আবার কী?

শচীন সাম্রাজ্যের নেপথ্যে: শচীনের ছোটবেলা

কেবল যে স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরেই সমর্থকের ভিড় জমেছে তেমনটি কিন্তু না। স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকে সামলাতে হয়েছে প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের জায়গা করে দেয়ার চ্যালেঞ্জও। এ তো আর পাঁচজন ক্রিকেটারের বিদায় না, সম্রাটের বিদায়, একটি সাম্রাজ্যের শেষ, খবর সংগ্রহ করার বাহানায় সেই দিনটার সাক্ষী হতে আসা এতো এতো সাংবাদিকদের প্রেসবক্সে জায়গা করে দেয়া সম্ভব হওয়ারও কথা না।


স্টেডিয়ামের মূল ফটকের বাইরে সেদিন ছিলো বিশাল সব ব্যানার। একটি ব্যানারে “বিএস: বিফোর শচীন” এবং “এএস: আফটার শচীন” নামে ক্রিকেট ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগও করে ফেলেছিলেন কিছু সমর্থক। না, আমি যাইনি, টিভিতেও দেখিনি। শুধু পড়েছিলাম উৎপল শুভ্রের লেখায়, অনুভব করেছিলাম শচীনের বিশালতা, আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম, এই শচীনকে ছেড়ে কিভাবে দিন কাটবে ভারতীয় সমর্থকদের?


- 'শচীন সাম্রাজ্যের নেপথ্যে' শিরোনাম দিয়ে সাম্রাজ্য শেষের গল্প করছি কেন?

- লেখা শুরুর আগে শচীন শব্দের ওজনটা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, যেন ভেতরে আমার করা ভুলগুলোকে সহজেই ক্ষমা করে দিতে পারেন। এতো বড় কাউকে নিয়ে আমার মতো ক্ষুদ্র কেউ লিখতে বসলে ভুলভ্রান্তি তো কিছু থাকবেই। এবার তবে শুরু করা যাক...


    একজন মানুষের সফল হওয়ার নেপথ্যে অনেক কিছুই থাকতে পারে। তার মেধা, পরিশ্রম, একাগ্রতা যেমন সফলতার পেছনের কারণ; তেমনি পরিবারের সকলের সমর্থন পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। শচীন যেমন এই সমর্থনটুকু সবসময়ই পেয়েছেন, তেমনি তার নিজের ছিলো মেধা, পরিশ্রমের মানসিকতা, ক্রিকেটটাকে বুঝে নেয়ার একাগ্রতা সবই। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঝড়-ঝঞ্ছাট না আসলে এমন একটা সাম্রাজ্য তো হওয়ারই ছিলো।

১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল, মহারাষ্ট্রের রমেশ-রজনী দম্পতির ঘরে আসে তাদের চতুর্থ সন্তান। সন্তানের নাম রাখা হলো শচীন। বাবা রমেশ টেন্ডুলকারের নামটা সাথে জুড়ে দিয়ে পুরো নাম শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। রমেশ-রজনী কি সেদিন ঘূর্ণাক্ষরেও ভেবেছিলো তাদের এই ছেলে একদিন বিশ্ব ক্রিকেটের শিরোমণি হবে? ভাবতে পারার কথাও না।


পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় শচীন সবসময় আদরেই বড় হয়েছে। শচীনের জীবনের প্রথম ব্যাটটা তার বড় বোনের দেয়া। ভাই নিতিন আর অজিতও পূরণ করেছেন ছোট ভাই শচীনের চাওয়া পাওয়া। বাবা-মায়ের কথা তো আলাদাভাবে বলতে হয় না।

শচীন সাম্রাজ্যের নেপথ্যে: শচীনের ছোটবেলা
শচীনের ছোটবেলা। (Image Source: My Autobiography: Playing It My Way)

'শচীন আর বাইসাইকেল'- এই শিরোনামে একটা গল্প করা যাক। গল্পের শিক্ষা দুটি। সাম্রাজ্যের নেপথ্যে যাদের থাকা চাই, তাদের মধ্য থেকে দুজনের উপস্থিতি।


    ছোট শচীনের বাইসাইকেল চাই। মুম্বাই শহরে সেসময় ৪ সন্তানের পরিবারের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতেই যে হিমসিম খেতে হয় সাধারণ একটি পরিবারকে, সেটা বুঝার ক্ষমতা তো তার তখনো হয়নি, তাই তার বাইসাইকেল চাই-ই চাই, বাইসাইকেল দিতেই হবে। বাইসাইকেল না পেলে বাসার বাইরে বেরোবে না। 

যেই কথা সেই কাজ, পুরো এক সপ্তাহ বাইরে বের হয়ে খেলতে যাওয়ার মতো অবশ্য পালনীয়, অতীব লোভনীয় ব্যাপারটিকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবস্থান বাসাতেই। একদিন তো রাগ দেখাতে গিয়ে বারান্দার গ্রিলের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে মাথাটাই ঢুকিয়ে দিয়েছিলো; বের করতে পারেনি। প্রায় আধাঘন্টা ওভাবেই আটকে থাকতে হয়েছিলো বাইসাইকেল চাওয়া শচীনকে।

কী আর করার? বাইসাইকেলতো দিতেই হবে। সাংসারিক হিসেব-নিকেশ নতুন করে কষে বাইসাইকেলের টাকাটা আলাদা করে নতুন একটা বাইসাইকেল ঠিকই কিনে এনে দিলেন বাবা রমেশ টেন্ডুলকার। চাওয়াকে পাওয়াতে পরিণত করার সংকল্প, সাথে নিজ পরিবার থেকে পাওয়া সমর্থন- সফল হতে গেলে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর মধ্য থেকে এ দুটি বিষয় যে শচীনের খুব ছোটবেলা থেকেই ছিলো তা বুঝাতেই এই গল্প বলা।

যদিও প্রথমদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েই একটা এক্সিডেন্ট করে বসে শচীন রমেশ। ডান চোখের উপরে দিতে হয়েছিলো ৮টি সেলাই। তবে ওই যে একাগ্রতা, ওই যে বাইরে খেলতে যাওয়ার মতো লোভনীয় বিষয়কেও আগ্রাহ্য করতে পারা, এসবই সে বজায় রাখতে পেরেছিলো ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও। 

খানিকটা এগিয়ে যাওয়া যাক... 

শিবাজী পার্কে শ্রী রমাকান্তের হাত ধরে শুরু হয় শচীনের প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট শিক্ষা। সেখানকারই একটা ঘটনা উল্লেখ করছি।  

    

   ১২ বছর বয়সী শচীন শিবাজী পার্কে চলমান এক ম্যাচে তার দলের অধিনায়ক। দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইনজুরড হয়ে মাঠ ছেড়েছে। দলপতি শচীন টিমের অন্য সবাইকে জিজ্ঞেস করলো কেউ উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে চায় কি না? হ্যাঁ সূচক কোনো উত্তর পেলো না, অধিনায়ক হিসেবে অন্য কাউকে জোড়াজুড়িও করলো না সেখানে পাঠানোর জন্য, গ্লাভস হাতে নিয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে গেলো উইকেটের পেছনে। উইকেটরক্ষক হিসেবে এটাই ছিলো শচীনের প্রথম! শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে সেখানে দাঁড়ালেন, চোখের নিচে আঘাত পেলেন; রক্তে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা।

বাড়ি ফিরতে হবে, ট্যাক্সিতে আসার টাকা নেই, বাসে এই রক্তাক্ত জামা-মুখ নিয়ে উঠতে ভয়, বন্ধুর সাইকেলের উপর ভরসা করলেও ব্যস্ততম মুম্বাইয়ের রাস্তায় সেটাও সম্ভব না। হেটেই ফিরতে হতো বাড়িতে, ফিরলোও হেটেই।

শুধু যে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ওই একবারই ইনজুরড হয়েছে শচীন, তেমনটি কিন্তু না। ব্যাটিং করার সময়ও হয়েছেন, কারণ হেলমেট পড়া যে নিষিদ্ধ ছিলো আর্চেকারের ক্রিকেটশালায়। কারণটা ছিলো বল ছাড়ার আর্টে এই ক্ষুদে ক্রিকেটারদের আর্টিস্ট হিসেবে গড়ে তোলা।  


স্কুল আর শিবাজী পার্কের মাঝে দূরত্বটা অনেকখানি, বাসে যেতে সময় লাগতো প্রায় দেড় ঘন্টা। সময় মতো বাস ধরতে না পারলেই দেরি হতো, সঙ্গী হতো ভ্রমণক্লান্তিও। এতসব চিন্তা করে শচীনকে রাখা আত্মীয় সুরেশ-মঙ্গলা দম্পতির বাড়ি। ছোট শচীন নিজ গৃহ ছেড়েছিলেন এই ক্রিকেটকে ভালোবেসে, শচীন নামক ক্রিকেট সাম্রাজ্যের ভীত প্রস্তুত হচ্ছিলো তখন থেকেই।


গ্রীষ্মকালীন অবকাশ; স্কুল ছুটি পুরো দুই মাসের জন্য। লম্বা ছুটিতে যেখানে সব ছেলেমেয়েরা চায় ঘুরে বেরাতে, শচীন সেখানে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিলো গুনে গুনে ৫৫টি।


- এই লম্বা ছুটির দিনগুলোতে শচীন কি শুধু প্র্যাকটিস ম্যাচই খেলেছে?

- না।

- তাহলে আর কী কী করতো?

- সকাল সাড়ে ৭ টার আগেই মাঠে উপস্থিত থাকতো, সাড়ে ৭ টা থেকে ২ ঘন্টার অনুশীলন শুরু।

২ ঘন্টায় মোট ৫টি নেট সেশন। ২ ঘন্টার প্র্যাকটিস সেশন শেষ করে শচীনের গন্তব্য ছিলো সোজা প্র্যাকটিস ম্যাচে।

বিকেল সাড়ে ৪ টা নাগাদ যখন ম্যাচ শেষ হয়, ততক্ষণে শক্তি, উদ্দম, ইচ্ছা সবই নিঃশেষে বিভাজিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শচীন যে ভালোবাসতো ক্রিকেটকে! ক্লান্তি, অবসাদ তাকে কখনোই স্থবির করতে পারেনি। ৩০ মিনিটের ছোট একটা বিরতির পর শচীন আবার শুরু করতো তার সন্ধ্যার সেশন।সকালের মতোই ২ ঘন্টা, ৫টি নেট সেশন। এসব শেষ করতে করতে সূর্য পশ্চিম আকাশকেও বিদায় বলে দিয়েছে, অন্ধকার নেমে গেছে।  


এখানে শেষ হলেও মানা যেত। কিন্তু এখানেও যে শেষ না ... 

এরপর শুরু হতো ১৫ মিনিটের আরও একটা সেশন। স্ট্যাম্পের উপর ১ রূপির একটি কয়েন রাখতেন শচীনের কোচ রমাকান্ত আর্চেকার, প্রত্যেক বোলার বল ছুড়তো, ফিল্ডিং করতো ১৬-১৭ জন। শর্ত থাকতো, একবারও যদি আউট না হয়ে ১৫ মিনিট শেষ করতে পারে শচীন, তবেই শচীন পাবে স্ট্যাম্পের উপর রাখা সেই ১ রুপির কয়েন খানা। এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কয়টি কয়েন নিজের করতে পেরেছিলো শচীন? গুনে গুনে ১৩টি।  


এখানেই শেষ? মোটেও না! প্যাড আর গ্লাভস পরে পুরো শিবাজী পার্কের চারপাশ দিয়ে চক্কর দিতে হতো দুইবার। বুঝুন তবে, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা কোন পর্যায়ে ছিলো শচীনের, শচীন নামের আলাদা এক ক্রিকেট সাম্রাজ্যের ভীতটাই বা কতটা মজবুত করে গড়ে উঠছিলো! 


শচীন নামের আলাদা এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য গড়ে উঠার নেপথ্যে আরও অনেক গল্পই আছে, করাও যাবে, তবে সব গল্পের মূলভাব একই, ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা; সাথে পরিশ্রম আর পরিশ্রম। ফলাফল, "শচীন রমেশ: এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য।"

এই লেখাটি পাঠগৃহ নেটওয়ার্কের 'মোঃ রবিউল মোল্লা'র লেখা "শচীন রমেশ: এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য" নামক ই-বুকের অংশ।
শচীনের ছেলেবেলা। ছোটবেলায় কেমন ছিলো শচীন। শচীনের বাইসাইকেল কেনার গল্প। শচীন টেন্ডুলকার কবে জন্মগ্রহন করেন? শচীনের প্রথম কোচ কে?
Md. Rabiul Mollah

Okay! So here I'm Md. Rabiul Mollah from Pathgriho Network. I'm currently a student of B.Sc in Textile Engineering Management at Bangladesh University of Textiles. facebook instagram github twitter linkedin

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺