আজ আমরা খুবই পরিচিত একটা প্রাণী নিয়ে মজার কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করব। আর আমাদের সেই পরিচিত প্রাণীটি হলো চিংড়ি। প্রথমেই আমি চিংড়ি নিয়ে আপনাদের মাঝে বিরাজমান একটি ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিতে চাই। আমরা প্রায় বলি যে, "চিংড়ি মাছ না, এটি একধরনের পোকা"। কথাটি ঠিক কতটুকু সত্য? এই কথাটিকে অর্ধেক সত্য আর অর্ধেক মিথ্যা বলা যায়। তাহলে তো বুঝাই যাচ্ছে যে কথাটির মাঝে ভেজাল আছে। চলুন সেই ভেজালটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি৷
চিংড়ি কী আসলেই পোকা?
চিংড়ি আসলেই মাছ না এটা ঠিক। তাহলে ভেজালটা নিশ্চয়ই চিংড়িকে পোকা বলে চালিয়ে দেয়ার মাঝে। তাই না? হুম, আসলেই তাই। সত্যি বলতে চিংড়ি পোকাও না। কথাটির সত্যতা পাওয়া যাবে আমরা যদি চিংড়ির শ্রেণিবিন্যাসের (Taxonomy) দিকে একটু খেয়াল করি। চিংড়ি হলো Arthropoda পর্বের Crustacea উপপর্বে অন্তর্ভুক্ত একটা প্রাণী। আর অন্যদিকে পোকাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে Arthropoda পর্বের Hexapoda উপপর্বে। চিংড়ি এবং পোকা একই পর্বে অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে এদের মধ্যে কিছু মিল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মিলগুলো লক্ষ্য করে চিংড়ি কে পোকা বলে চালিয়ে দেয়া একদমই মানায় না। কারণ এরা সম্পূর্ণ আলাদা উপপর্বের প্রাণী। যার ফলে চিংড়ি আর পোকার মাঝে শারীরিক পার্থক্যগুলোর পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও আবাসস্থলগত অনেক পার্থক্যই পরিলক্ষিত হয়। এদের মাঝে বিদ্যমান অনেক পার্থক্য থেকে আমি আপনাদের একটা প্রধান পার্থক্য বলে দিই যেটা একদম চোখে পড়ার মতই। পোকাদের পা হলো ৬ টা যেখানে চিংড়ির পা হলো ১০ টা। এজন্য পোকাদের Hexapod বলা হয় আর চিংড়ি কে বলা হয় Decapod। এখন তাহলে আপনারা অন্যান্য পার্থক্যগুলোও খুঁজে বের করে ফেলুন আস্তে আস্তে।
আশা করি আপনাদের ভুলটি এখন ভাঙ্গাতে পেরেছি। আর এটা কিন্তু কোনো ছোট খাটো ভুল ছিলনা। অনেক বড় একটি ভুলই বলা যায় এটাকে। কারণ কি বলুনতো? হয়তো দেখা গিয়েছে যে একজন মানুষের চিংড়ি খুবই প্রিয় একটা খাবার ছিল। কিন্তুু যখনই সেই মানুষটা শুনেছে যে চিংড়ি হলো একধরনের পোকা ঠিক তখন থেকেই চিংড়ি খাওয়া একদম বন্ধই করে দিয়েছে। দেখুন না একটা ভুল তথ্যের খপ্পরে পড়ে মানুষটা তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারটাও বিসর্জন দিয়ে দিল। বিষয়টি এখন হাস্যকর মনে হলেও অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে। আর আপনার আশেপাশে এরকম কাউকে পেলে তার এই ভুল ধারণাটি দূর করে দেয়ার চেষ্টা করুন।
চিংড়ির সাথে পোকাদের অনেক সাদৃশ্যতার দরুন অনেকেই চিংড়ি কে আবার সমুদ্রের তেলাপোকা বলে থাকে।
চিংড়ি কেন মাছ নয়?
চিংড়ি যে পোকা না সেটা বুঝার পরে অনেকের মনে এখনো হয়তো আরেকটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে যে চিংড়ি আসলে কেনো মাছ না। এর কারণ হলো মাছ একদম আলাদা একটা পর্বের প্রাণী। মাছকে Chordata পর্বে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেখানে আমরা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি যে চিংড়ি হলো Arthropoda পর্বের প্রাণী। তাই এদের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য আছে। আর এজন্যে চিংড়ি অবশ্যই মাছ না।
কিন্তুু চিংড়ি যে মাছ না এটা জানার পরেও আমি, আপনি সেই আগের মতই মাছ বাজারে গিয়ে বলবো, " মামা, চিংড়ি মাছ কত করে?" হাহাহা। এরকম কিছু বিষয় ভুল জানার পরেও আমরা সেই ভুলটাই প্রয়োগ করতে পছন্দ করি। যেমন আমরা ভর ও ওজনের মধ্যে পার্থক্য খুব ভলো করে জানলেও আজও ভরকে ওজন বলেই চালিয়ে যাচ্ছি।
চিংড়ি মাছ নয়, তবুও আছে জাতীয় মৎস খাতে
ও আচ্ছা, মজার একটা ব্যাপার হলো মাছ না হওয়া সত্বেও আমাদের জাতীয় মৎস্য খাতে অন্তর্ভুক্ত অন্যতম একটা মাছ কিন্তু এই চিংড়ি। আর চিংড়ি বাণিজ্যিক ভাবে রপ্তানি করে আমাদের দেশ প্রতি বছরই আয় করে আসতেছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। তাই বুঝতেই পারছেন যে জাতীয় অর্থনীতিতে চিংড়ি চাষ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেছে। আর এজন্যই চিংড়ি কে বলা হয় White Gold Of Bangladesh।
চিংড়ি মাছ না, পোকাও না। তাহলে এখন চিংড়িকে ঠিক কি বলা যায়?
এটাই ভাবছেনতো। চিংড়িকে আপনারা শেলফিস বলতে পারেন। না না, স্বার্থপর না। Shellfish হলো খোলসযুক্ত অমেরুদণ্ডী জলজ মোলাস্ক বা ক্রাস্টাশিয়ান প্রাণী যেগুলো খাওয়ারযোগ্য। পুরো পৃথিবী জুড়েই চিংড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি Seafood। অনেক মুখরোচক খাবার তৈরি করা যায় চিংড়ি থেকে।
চিংড়ির হৃদপিন্ড আসলেই মাথায় থাকে?
এখন আপনাদেরকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মত একটা তথ্য দিতে যাচ্ছি। একটু নড়েচড়েই বসুন। আপনারা কি জানেন যে চিংড়ির হৃদপিণ্ড এর মাথায় থাকে? অবাক হচ্ছেন তাইতো? আচ্ছা বিষয়টা একটু ভেঙ্গে বলা যাক। চিংড়ির দেহকে মূলত প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। মাথা এবং লেজ। মাথার মূল অংশের ঠিক পরেই চিংড়ির বক্ষাঞ্চল। এই অংশেই মূলত চিংড়ির হৃদপিণ্ড থাকে। কিন্তু এই বক্ষাঞ্চলকে চিংড়ির দেহের আলাদা অংশ না ধরে মাথার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কারণ চিংড়ির মাথা এবং বক্ষ একটি মাত্র বহিঃকঙ্কাল দ্বারা আবৃত থাকায় এই দুই অংশ মিলেই মূলত মাথার অংশটি গঠিত। তাই এই অংশটিকে Cephalothorax বলা হয়ে থাকে। আর এজন্য দৈহিক গঠনতন্ত্রের বিবেচনায় আমরা বলতে পারি যে চিংড়ির হৃদপিণ্ড এর মাথায় অবস্থিত। এখন হয়তো আগের মত এতটা অবাক লাগছেনা, তাই না?
আজ চিংড়ি নিয়ে কিন্তু অনেক গল্পই করে ফেললাম আপনাদের সাথে। আশা করি তথ্যগুলো আপনাদের ভালো লেগেছে। এখন আমার বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা বিস্ময়কর ও মজার মজার বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করুন। আল্লাহ হাফেজ।