আমাদের এই উপমহাদেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারে হুন্ডি-হাওয়ালা একটি অধিক পরিচিত এবং প্রচলিত শব্দ। আমরা অনেকেই এই শব্দের অর্থ জানিনা বা এটা দ্বারা কি বুঝানো হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে বৈধ নাকি অবৈধ এ সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের অনেকেরই থাকে না। এই আর্টিকেলে আমরা হুন্ডি সম্পর্কিত সকল প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
হুন্ডি কি?
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ প্রেরণের মুগল আমলে চালু একটি কৌশলকে হুন্ডি (Hundi) বলে। এ পদ্ধতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু শর্ত তৈরি করা হয় এবং সেই শর্ত সাপেক্ষে একজন ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তির অর্থ নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেন এবং তার বিনিময়ে শর্তসাপেক্ষে অর্থ গ্রহণ করেন অথবা কিছু ক্ষেত্রে গ্রহণ না করাও হতে পারে তবে সেটা শর্তে উল্লেখ থাকে।
এই উপমহাদেশে এই প্রথার প্রচলন মূলত মোগল আমলে শুরু হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মোগল আমল থেকে শুরু করে বর্তমানেও এই হুন্ডি বা হাওয়ালা জিনিসটা আমাদের উপমহাদেশে এখনও প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এর কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন এখনও ব্যাপক পরিমাণে দেখা যায় যদিও এ সকল দেশে এটি অবৈধ।
হুন্ডির একটি সহজ উদাহরন
সংজ্ঞা থেকে হুন্ডি-হাওয়ালার ব্যাপারে সম্পূর্ণ বুঝা অনেকটা কষ্টকর এজন্য আমরা নিচে একটি সাধারন উদাহরণের মাধ্যমে আপনাদেরকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছি। অবশ্যই নামগুলোকে ঠিকভাবে লক্ষ্য করুন, তবে বিষয়টা বুঝতে পারবেন।
ধরুন রাকিব ও সাকিব দুজন বন্ধু জাপানে চাকরি করেন। তাদের সঙ্গে তাদের পাশের গ্রাম থেকে রবিউল চাকরি করেন। রবিউল তার গ্রামের বাড়িতে জাপানের ব্যাংক থেকে টাকা পাঠাতে চান। সেই ক্ষেত্রে তিনি দেখতে পেলেন ব্যাংকে দু'লক্ষ টাকা পাঠানোর জন্য আরো খরচ বাবদ 20,000 টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ তিনি যদি বাড়িতে দু'লক্ষ টাকা পাঠাতে চান তবে তাকে দু লক্ষ 20 হাজার টাকা জমা দিতে হচ্ছে।
রাকিব রবিউলকে বলল যে রাকিব পরবর্তী সপ্তাহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন তো সেই ক্ষেত্রে রবিউল চাইলে তার কাছে টাকাটা দিতে পারে। সে রবিউলের বাড়ির লোকজনকে টাকাটা পৌঁছে দেবে এবং শর্ত রাখলেন যে এর জন্য রবিউল রাকিবকে 5000 টাকা দিবেএক্ষেত্রে রবিউলের 15000 টাকা বেঁচে যাচ্ছে।
তারা সাকিবকে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি হিসেবে রাখলেন এবং একটি শর্ত পত্র (যা হুন্ডি স্লিপ নামে পরিচিত) তৈরি করলেন যেখানে রাকিবকে রবিউলের বাড়িতে দু'লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে এবং সাক্ষী হিসেবে সাকিবকে রাখা হয়েছে। উক্ত পুরো ঘটনাটি হুন্ডির একটি আদর্শ উদাহরণ।
আরো দেখুন: বাংলাদেশের সকল এলাকার পোষ্টকোড সহজে খুঁজুন
হুন্ডি কেন অবৈধ?
আপাদমস্তকে হুন্ডির মূল বিষয়টাকে সহজ এবং সাহায্যকারী মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়টাতে সুবিধার থেকে অসুবিধাগুলো বেশি এবং এতে অস্বচ্ছতা থাকে বলে প্রতিবছর অনেক মানুষ তাদের অর্থকে হারাচ্ছেন। যেহেতু এটাতে একটি দেশের অর্থব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে অর্থ অন্য একটি স্থানে পাঠানো হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে সেই দেশের অর্থনীতির জন্য এটা কিন্তু অনেকটাই ক্ষতিকর।
বিশ্বের অনেক দেশে এটাকে সম্পূর্ণ অবৈধ একটি পথ হিসেবে ধরা হয়। কেননা এতে করে যেমন সরকার কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঠিক তেমনি ভাবে যে দেশে অর্থটা পাঠানো হচ্ছে সেই দেশও কিন্তু সেটি থেকে আলাদাভাবে লাভবান হতে পারছে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে হুন্ডির টাকা প্রকৃতপক্ষে যাদের কাছে পৌঁছানোর কথা তাদের কাছে পৌঁছায় না। তার আগে মধ্যবর্তী ব্যক্তিবর্গ সেটাকে আত্মসাৎ করেন এবং এতে করে যে ব্যক্তি টাকাগুলোকে পাঠাচ্ছেন তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হন। এইজন্য বিভিন্ন দেশের সরকার এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
হুন্ডি কেন এখনও প্রচলিত রয়েছে?
হুন্ডি চলিত থাকার মূল কারণ হচ্ছে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্ব এবং প্রযুক্তির সাথে মেলবন্ধন তৈরি হওয়ার অপারগতা। আমাদের দেশ থেকে যেসকল জনশক্তি বাহিরে কাজ করছেন এবং প্রতিনিয়ত দেশের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছেন তাদের অনেকেই ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে অক্ষম হন। তেমনভাবে লেখাপড়ার না জানার কারণে সর্বদায় তারা ব্যাংকিং সেক্টরকে ভয়ের দৃষ্টিতে দেখেন।
আর মূলত এই বিষয়টাকে কাজে লাগান যারা হুন্ডি ব্যবসায়ী। তারা ঐ সকল লোকেদের লোভনীয় বেশ কিছু বিষয় দেখান যাতে করে তাদের নিকটে অর্থগুলো তারা পাঠান।
তবে যারা দক্ষ ব্যক্তি এবং পূর্বে বাইরের দেশে কাজে যাওয়ার আগে ব্যাংকিং সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রেখেছেন তাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তারা অর্থগুলোকে এই নিয়মে দেশে পাঠান না। বরঞ্চ ব্যাংকিং সেক্টরে তারা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এর মূল কারণ হচ্ছে বর্তমানে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে খুব অল্প পরিমাণ অর্থের মাধ্যমে রেমিটেন্স দেশে পাঠানো যায়! এবং সেই ক্ষেত্রে উল্টো বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন ব্যাংকে রেমিটেন্স এর জন্য বিভিন্ন ছাড় ও বোনাস থাকে।
অপরদিকে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে আপনি আপনার অর্থের জবাবদিহিতা করতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি যদি অর্থটাকে পাঠান ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে তবে আপনার পরিবার যদি সেই টাকাটা কে ঠিক ভাবে হাতে না পায় আপনি ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারবেন। যেকোন ব্যাংক কিন্তু আপনার জবাবদিহিতা দিতে বাধ্য। কেননা আপনি তাদের সেবা গ্রহণ করেছেন এবং সেবার পরিবর্তে যদি আপনাকে তারা ঠকায় বা তাদের হিসাবের কোন ভুল হয় তবে তার জন্য আপনি জবাবদিহিতার মধ্যে ফেলতে পারবেন।
অপরদিকে আপনি যখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকাগুলো পাঠাচ্ছেন সেই ক্ষেত্রে আপনি কারো সাথে এধরনের জবাবদিহিতামূলক কাজগুলো আইনের সাহায্য করতে পারবেন না। কেননা এটি অলরেডি অবৈধ। এক্ষেত্রে সব সময় আপনি বৈধ পথে অর্থগুলোকে দেশে আনবেন বা দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠাবেন। এতে আপনি যেমন দেশের উন্নতিতে সাহায্য করবেন ঠিক তেমনিভাবে নিজের অর্থগুলোকে কোনভাবে বিপদে ফেলছে না।
এই ছিল আমাদের এই আর্টিকেলটি। যদি এ ধরনের আরো তথ্যবহুল আর্টিকেল আপনি পড়তে চান তবে অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে দেখতে পারেন। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল এখানে পাবলিশ করে থাকি।