ভেক্টর সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই জানতে হবে রাশি কি? তাহলে শুরু করা যাক, রাশি নিয়েই।
রাশি কী?
এই মহাবিশ্বে যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তাকেই রাশি বলে। উদাহারণস্বরূপ, আপনি এখন যে ডিভাইস ব্যবহার করে এই লেখাটি পড়ছেন সেই ডিভাইসের ভর আছে, দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ আছে। তাই ভর, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এরা প্রত্যেকেই রাশি। আবার কতক্ষণ যাবৎ পড়ছেন তাই পরিমাপ করা যায়। তাই সময়ও একটি রাশি। এমনভাবে বেগ, ত্বরণ, সরন, ওজন সবকিছুই রাশি
ভৌত রাশি কাকে বলে?
পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত যেকোনো রাশিকেই ভৌত রাশি বা Physical Quantity বলা হয়। উল্লখ্য, রাশির ইংরেজি শব্দ quantity।
পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্গত সকল রাশিকে অর্থাৎ ভৌত রাশিকে প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের ভিত্তিতে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
- স্কেলার রাশি বা অদিক রাশি (Scaler Quantity)
- ভেক্টর রাশি বা দিক রাশি (Vector Quantity)
নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে, একটি রাশির সাথে দিক সম্পর্কিত, অন্যটির সাথে দিকের সম্পর্ক নেই। তাহলে এদের সংজ্ঞাগুলো আলাদা আলাদাভাবে দেখে নেয়া যাক। তাতেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে আশা করি।
স্কেলার রাশি কাকে বলে?
যেসব ভৌত রাশিকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে শুধু মানই যথেষ্ট, দিকের প্রয়োজন নেই, সেসব রাশিকেই বলা হয় স্কেলার রাশি। যেমন ভর, সম, তাপমাত্রা, দৈর্ঘ্য, দ্রুতি ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক বিভবও স্কেলার রাশি। বৈদ্যুতিক বিভব কেন স্কেলার রাশি তা আমরা একটু পরে জানব।
ভেক্টর রাশি কাকে বলে?
যেসব ভৌত রাশিকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার জন্য মান ও দিক উভয়ের প্রয়োজন হয় সেসব রাশিই ভেক্টর রাশি। যেমন ওজন, বল, ত্বরণ, মন্দন, সরণ, বেগ ইত্যাদি সবই ভেক্টর রাশির উদাহারণ।
বৈদ্যুতিক বিভব স্কেলার নাকি ভেক্টর?
বৈদ্যুতিক বিভব একটি স্কেলার রাশি। প্রচলিত অর্থে এর দিক আছে মনে হলেও আসলে এর নির্দিষ্ট কোনো দিক নেই। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, উপর, নিচ এমন কোনো দিক নেই। আবার উচ্চ বিভব-নিম্ম বিভব অঞ্চলকে হিসেবে আনলেও আসলে একটি নির্দিষ্ট দিক হচ্ছে না। ধনাত্মক চার্জ এবং ঋণাত্মক চার্জ উভয়ই দিক পরিবর্তন করছে বলেই বৈদ্যুতিক বিভবের সৃষ্টি হচ্ছে।
ভেক্টর রাশির ধর্ম
- ভেক্টর রাশির মান এবং দিক দুটিই আছে। এই জন্যই তারা ভেক্টর রাশি।
- একের অধিক সমজাতীয় ভেক্টরকে যোগ করা যায়, ভিন্ন জাতের দুটি ভেক্টরকে যোগ করা যায় না। সমজাতীয় ভেক্টর বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
- দুটি ভেক্টরকে যোগ করলে যে ভেক্টর পাওয়া যায়, তাই ওই দুই ভেক্টরের সম্মিলিত ক্রিয়ারই ফল। একে লব্ধি ভেক্টর বলে। লব্ধির মান ও দিক নির্ণয়ের প্রক্রিয়া জানার জন্য লিংকড আর্টিকেলে ক্লিক করুন।
- দুটি ভেক্টরের ভেক্টর গুণফল বা ক্রস গুণফল একটি ভেক্টর রাশি এবং স্কেলার গুণফল বা ডট গুণফল একটি স্কেলার রাশি।
- ভেক্টর রাশি সংযোগ ও বন্টন সূত্র মেনে চলে। এ দুটি সূত্র নিয়েও নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
- ভেক্টর রাশিকে উপাংশে ভাগ করা যায়।
সমজাতীয় ভেক্টর বলতে কি বুঝায়?
সংজ্ঞা তো আমরা জানি বা জেনে নিতে পারবো। কিন্তু সংজ্ঞা থেকে আমরা আসলে পুরোপুরি হয়তো বুঝতে পারি না। ভেক্টর যোগের সময় মনে রাখবেন, দুটি সমজাতীয় ভেক্টরেরই কেবল যোগ করা যায়। এখন এই সমজাতীয় ভেক্টর কি? দুটি ত্বরণের ভেক্টর সমজাতীয় ভেক্টর, দুটি বেগের ভেক্টর সমজাতীয় ভেক্টর। তাই দুটি ত্বরণের ভেক্টরের যোগ করা যাবে, দুটি বেগের ভেক্টরেরও যোগ করা যাবে। কিন্তু একটি ত্বরণের এবং একটি বেগের ভেক্টরের যোগ করা যাবে না। কারণ তারা ভিন্ন জাতীয় ভেক্টর।
সংযোগ সূত্র ও বন্টন সূত্র
সংযোগ সূত্র: A + (B+C) = (A + B) +C
বন্টন সূত্র: mA + mB = m(A+B)
বিভিন্ন প্রকারের ভেক্টর
একক ভেক্টর কাকে বলে?
যে সকল ভেক্টরের মান শূন্য নয় এরূপ কোনো ভেক্টরকে ওই ভেক্টরের মান দ্বারা ভাগ করলে যে ভেক্টর পাওয়া যায় তাকে একক বলে। অর্থাৎ, যে ভেক্টরের মান এক একক তাকে একক ভেক্টর বলে। আবার কোনো ভেক্টরের মানকে ওই ভেক্টরের একক ভেক্টর দ্বারা গুণ করলে ওই ভেক্টরটি পাওয়া যায়।
শূন্য ভেক্টর বা নাল ভেক্টর কাকে বলে?
যে ভেক্টরের মান শূন্য, তাকে শূন্য ভেক্টর বলা হয়। শূন্য ভেক্টরের নির্দিষ্ট দিক থাকে না। একসাথে বলতে গেলে, যে ভেক্টরের মান শূন্য এবং যার নির্দিষ্ট কোনো দিক থাকে না, তাকে নাল ভেক্টর বা শূন্য ভেক্টর বলা হয়। দুটি সমান এবং বিপরীতমুখী ভেক্টর একই বিন্দুতে একই সাথে ক্রিয়া করলে তাদের লব্ধি একটি নাল ভেক্টর। নাল ভেক্টরের কেন কোনো দিক থাকে না তা আমরা নিচে আলোচনা করেছি।
অবস্থান ভেক্টর কাকে বলে?
প্রসঙ্গ কাঠামাের মূল বিন্দুর সাপেক্ষে কোনো বিন্দুর অবস্থান যে ভেক্টরের সাহায্যে নির্ণয় বা নির্দেশ করা হয় তাকে অবস্থান ভেক্টর বলে।
ব্যাসার্ধ ভেক্টর কাকে বলে?
মূল বিন্দু থেকে কোনো বস্তুর অবস্থানের দূরত্বকে ব্যাসার্ধ ভেক্টর বলে। অনেক সময় অবস্থান ভেক্টরকেই ব্যাসার্ধ ভেক্টর বলা হয়।
সরণ ভেক্টর কাকে বলে?
সরল পথে বা নির্দিষ্ট দিকে কোনো বিন্দুর অতিক্রান্ত দূরত্বকে সরণ ভেক্টর বলে।
বিপ্রতীপ ভেক্টর কাকে বলে?
দুটি সমান্তরাল ভেক্টরের একটির মান অপরটির বিপ্রতীপ (5 এর বিপ্রতীপ হলো 1/5) হলে তাদেরকে বিপ্রতীপ ভেক্টর বলে।
সদৃশ ভেক্টর কাকে বলে?
সমজাতীয় অসম মানের দুটি ভেক্টর যদি একই দিকে ক্রিয়া করে তবে তাদেরকে সদৃশ ভেক্টর বলা হয়।
সমরেখ ভেক্টর কাকে বলে?
দুই বা ততোধিক ভেক্টর যদি একই সরলরেখা বরাবর বা পরস্পর সমান্তরালে ক্রিয়া করে তবে তাদেরকে সমরেখ ভেক্টর বলে।
সমতলীয় ভেক্টর কাকে বলে?
একাধিক ভেক্টর একই তলে অবস্থান করলে তাদেরকে সমতলীয় ভেক্টর বলে।
বিপরীত ভেক্টর কাকে বলে? বা ঋণ বা ঋণাত্মক ভেক্টর কাকে বলে?
বিপরীত দিকে ক্রিয়ারত দুটি সমজাতীয় ভেক্টরের মান সমান হলে তাদেরকে একে অপরের বিপরীত বা ঋণ বা ঋণাত্মক ভেক্টর বলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নির্দিষ্ট দিক বরাবর কোনো ভেক্টরকে ধনাত্মক ধরলে তার বিপরীত দিকে সমমানের এবং সমজাতীয় ভেক্টরকে বিপরীত ভেক্টর বলে।
লব্ধি ভেক্টর কাকে বলে?
একাধিক ভেক্টরের সমন্বয়ে যে নতুন ভেক্টর পাওয়া যায় তাকেই লব্ধি ভেক্টর বলে।
সমভেক্টর কাকে বলে?
দুটি সমজাতীয় ভেক্টরের মান ও দিক একই হলে তাদেরকে সমভেক্টর বলা হয়।
তল ভেক্টর কাকে বলে?
যেকোনো তলের উপর অংকিত অভিলম্ব বরাবর একটি ভেক্টর যার মান তলটির ক্ষেত্রফলের সমান, তাকে ওই তলের তল ভেক্টর বলে।
এবার কিছু অনুধাবন মূলক প্রশ্নের উত্তর করা যাক।
নাল ভেক্টরের সুনির্দিষ্ট দিক নেই কেন? (রাজশাহী বোর্ড, ২০১৫)
যখন কোনো ভেক্টরের আদি বিন্দু এবং শেষ বিন্দু একই স্থানে হয়, তখন তা একটি বিন্দুতেই পরিণত হয়, রেখাতে নয়। বিন্দুর কোনো দিক নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই নাল ভেক্টরের সুনির্দিষ্ট কোনো দিক নেই।
স্বাধীন ভেক্টরের পাদবিন্দু মূল বিন্দুতে নয় কেন? (সিলেট বোর্ড, ২০১৫)
স্বাধীন ভেক্টরের পাদবিন্দু কোথায় হবে তা ইচ্ছেমতো ঠিক করা যায়। যেহেতু পাদবিন্দু কোথায় হবে তা নির্দিষ্ট না, তাই মূল বিন্দুও নির্দিষ্ট না। একারণেই স্বাধীন ভেক্টরের পাদবিন্দু মূল বিন্দুতে নয়।
ভেক্টরের মান কখন ঋণাত্মক হয় ও কেন- ব্যাখ্যা কর। (দিনাজপুর বোর্ড, ২০১৫)
প্রশ্নটি হয়তো ভুল নয়তো ট্যাকটিক্যাল। আদতে ভেক্টর ঋণাত্মক হতে পারে কিন্তু ভেক্টরের মান কখনো ঋণাত্মক হতে পারে না। কারণ ভেক্টরের মান বলতে আমরা বুঝিই পরম মানকে। পরম মান ঋণাত্মক হয় না বিধায় ভেক্টরের মান ঋণাত্মক হয় না। তবে ভেক্টর ঋণাত্মক হতে পারে যা উপরে সংজ্ঞা থেকে পড়ে নিলেই হবে।
আরও পড়ুন: