আল-ফারাবি (আনুমানিক ৮৭০-৯৫০ খ্রি:)
দর্শনশাস্ত্রে
অনন্য ভূমিকার কারণে “দ্যা সেকেন্ড টিচার” হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আল ফারাবির পূর্ণ নাম
ছিলো আবু নাসের মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল ফারাবি। “প্রথম শিক্ষক” হিসবে বিবেচিত
ছিলেন অ্যারিস্টটল। আল ফারাবি দর্শনশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর রচিত
‘আলা আহলে আল মদীনা আল ফাদিলা/দ্যা ভার্চুয়াস সিটি’ গ্রন্থটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
এই বইটির বিষয় বস্তু ছিলো দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি প্লেটোনিজম
দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তাকে ইসলামিক নিওপ্লেটোনিজম এর গোড়াপত্তনকারী হিসেবেও বিবেচনা
করা হয়। দার্শনিক ম্যামোনাইডস তাকে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম যুক্তিবাদী বলেছেন।
দর্শন ছাড়াও
সঙ্গীতে আল ফারাবির ‘কিতাব আল মুসিকি আল কবির/দ্যা গ্রেট বুক অব মিউজিক’ও প্রসিদ্ধি
লাভ করে। এছাড়াও তিনি পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানেও অবদান রাখেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে
‘শূন্যতার’ অবস্থান প্রমাণ করেন। তিনি মহাবিশ্বের একটি মডেলও প্রদান করেছিলেন।
আল ফারাবি ৮৭০ মতান্তরে ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কির ফারাব শহরের নিকটবর্তী ‘আল ওয়াসিজ’ নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। তিনি জ্ঞানার্জনের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। আল ফারাবি আনুমানিক ৯৫০ সালে দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘ফারাবিয়াস’ নামে পরিচিত।
আল-ইদ্রিসি (আনুমানিক ১১০০-১১৬৫)
বর্তমান পৃথিবীতে
পকেটের মোবাইল ফোনটি বের করে গুগল ম্যাপসে চলে গেলেই পুরো পৃথিবীর অলিগলি দেখতে পাই
মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু বহুকাল আগে তা মোটেও এতোটা সহজ ছিলো না। তখনকার সময়ে মানচিত্র
তৈরি সহজ কোনো ব্যাপার ছিলো না। এই কঠিন কাজটি অনেকেই করে দেখিয়েছেন, তাদের মধ্যে আল-ইদ্রিসি
অন্যতম একজন।
আবু আবদুল্লাহ
মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রিস আল শরীফ আল ইদ্রিসি তাঁর পুরো
নাম। পশ্চিমারা তাকে ‘ড্রেসেস’ নাম দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে তিনি ইসলামের শেষ নবী ও রাসূল
মুহাম্মাদ (স) এর বংশধর। ১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি মরোক্কার সাবতায় (বর্তমান স্পেনের
সেউটা) জন্মগ্রহন করেন। স্পেনের কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং বিভিন্ন স্থানে
ভ্রমণ করেন।
তাঁর বই
‘The Excursion of One Who is Eager to Traverse the Regions of the World’ ভুগোল এবং
মানচিত্র নির্মানবিদ্যায় ইতিহাসের অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত। ১১৪৫ সালে সিসিলির
রাজা দ্বিতীয় রজার তাকে বিশ্বের একটি নতুন এবং উপযুক্ত মানচিত্র তৈরি করতে বললে তিনি
তাতে সাঁয় দেন। আল-ইদ্রিসি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভূগোলবিদদের প্রেরণ করেন। ১১৫৪ খ্রিষ্টাব্দে
রাজা দ্বিতীয় রজারের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আল-ইদ্রিসি তাঁর যুগান্তকারী কাজ শেষ করেন
এবং ‘The Excursion of One Who is Eager to Traverse the Regions of the World’ বইটি
সম্পন্ন করেন। তাঁর এই বই ল্যাটিনে অনূদিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায়। ১১৬৫
সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনে বতুতা (১৩০৪-১৩৬৮)
বিশ্ববিখ্যাত
পর্যটক শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই ‘রিহলা/
তুহফাতুন-নুজ্জার ফি গারাইবিল আমসার
ওয়া আজাইবিল আস্ফার' (A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and
the Marvels of traveling) বিশ্ব ইতিহাসে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক,
ধর্মীয়সহ আরও বহুদিকের একটি যুগান্তকারী প্রমাণ। তাঁর এই বইটি ১৩৫৫ সালে প্রকাশিত হয়,
ইংরেজিতে অনূদিত হয় ১৯৫৮ সালে, বিশ্বের অন্যান্য ভাষায়ও এর অনুবাদ হয়েছে।
ইবনে বতুতা
সৌদি আরব, ইরাক, সোমালিয়া, মধ্য এশিয়া, চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ আরও অনেক জায়গায় ভ্রমণ
করেছেন। এবং এই সব অঞ্চলের জনমানুষের জীবন, আবহাওয়া, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা
ইত্যাদি বিষয় তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন যা বর্তমান সময়ে বসে অতীত বিশ্ব সম্পর্কে
জানার প্রধান হাতিয়ারগুলোর একটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইবনে বতুতা
১৩০৪ সালের ১৪ই জুন মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহন করেন। ১৩২৫ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি
হজ্জ পালন করতে মরক্কোর বাইরে যান এবং পরবর্তীতে মরক্কোতে ফিরে আসেন ২৪ বছর পর। এই
২৪ বছরে তিনি পৃথিবী ঘুরে দেখেছেন, সাথে আরও দুই বার হজ্জ করেছেন। ১৩৩৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর
ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন ইবনে বতুতা। ১৩৪৬ সালে হযরত শাহজালাল (রহ)-এর সাথে দেখা করার
উদ্দেশ্যে ইবনে বতুতা আসেন বর্তমান বাংলাদেশে। তাঁর বইতে তিনি এ অঞ্চল সম্পর্কে বলেছেন,
“খোরাসানের লোকেরা দেশটিকে (বাংলাদেশকে) বলে থাকে প্রাচুর্যপূর্ণ দোযখ।“ ইবনে বতুতা
১৩৮৬ সালে মরক্কোয় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
- Fārābī: Abū Naṣr Muḥammad ibn Muḥammad ibn Tarkhān al‐Fārābi
- Al-Idrisi
- The Travels of Ibn Battuta: in the Near East, Asia and Africa
আরও পড়ুন
- জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখায় মুসলমানদের অবদান
- ওমর খৈয়াম: কবিতা আর বিজ্ঞানে অমর হয়ে থাকা একজন
- হাসান ইবনে আল হাইসাম: আলোকবিজ্ঞানের জনক যিনি
- আব্বাস ইবনে ফিরনাস: প্রথমবার সফলভাবে আকাশে উড়েছিলেন যিনি