বর্তমান সময়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এমন অসংখ্য কাজ বা সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা প্রায়শই ছুটে যাই সেই গুগলের কাছেই। গুগল নামক সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করি অজানা কোনো তথ্য যা আমি খুঁজছিলাম। গুগলের মতোই সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু, বিং, ডাক-ডাক-গো কিংবা ইয়ান্ডেক্সরা। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের এত প্রশ্নের উত্তর এত সহজে পেয়ে যাওয়ার মাধ্যম এই সার্চ ইঞ্জিনের ইতিহাসটা আসলে কী? সর্বপ্রথম কে, কবে সার্চ ইঞ্জিনের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন সমস্ত পৃথিবীর সামনে? কীভাবে পরিবর্তিত হতে হতে সার্চ ইঞ্জিনগুলো আজকের এই অবস্থানে এসেছে? এসবের বিস্তারিত নিয়েই আজকের এই "সার্চ ইঞ্জিনের ইতিহাস" নামক আর্টিকেল।
গুগলের আগে মানুষ কিভাবে সার্চ করতো?
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উল্টে মাত্র দুই দশক পেছনে গেলেই ইন্টারনেটকে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে তা মোটেও আজকের ইন্টারনেট জগতের সাথে বিন্দুমাত্র সাদৃশ্যপূর্ণ না। তখন তা ছিল শুধু লিংকের সমাহার, সংগ্রহ। কারও কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে তাকে একের পর এক লিংকে ক্লিক করে যেতেই হতো ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না সে তার প্রয়োজনীয় তথ্যটি খুঁজে পাচ্ছে। লিংকে প্রবেশ না করে বাইরে থেকে কোনোভাবেই জানা যেত না ভেতরের ফাইলটি কোন বিষয়ের উপর। একেবারেই বিরক্তকর, তাই না? এখনকার সময়ে গেমিং পিসির সামনে বসে তেমনটা ভাবাই যায় না। তবে সে পর্যন্ত আসতেও পেরোতে হয়েছে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা। কেটেছে অনেকগুলো বছর।
আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে আধুনিক সার্চ টেকনোলজির জনক কে? জাগেনি? না জানলে এই আর্টিকেল কেনো পড়তে এসেছেন? এসেছে হয়তো, বুঝেননি। সে যাই হোক, একেবারে বিতর্ক ছাড়া সার্চ টেকনোলোজির জনক কে সেই উত্তরটা না থাকলেও অনেকেই মনে করেন জেরার্ড স্যাল্টনই আধুনিক সার্চ টেকনোলজির জনক। তিনি তৈরি করেছিলেন SMART বা Salton’s Magic Automatic Retriever of Text যা সাড়া ফেলে দিয়েছিলো সে সময়কার অনেক গবেষকদের মধ্যেই। তার লেখা বই "A Theory of Indexing"-এ উল্লেখ করা কিছু পদ্ধতি, কিছু অ্যালগরিদমের উপর অনেকটা ভিত্তি করেই সার্চ ইঞ্জিনগুলো কাজ করছে। তারই সমসাময়িক টেড নেলসনের প্রজেক্ট জানাডু (Project Xanadu)-ও শোরগোল ফেলেছিল বিজ্ঞানী মহলে। WWW বা World Wide Web সৃষ্টির পেছনে টেড নেলসনের পরীক্ষাগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা আছে।
এভাবেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের ভাবনা, পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে আসে প্রথম সার্চ ইঞ্জিন আর্চি (Archie), যা তৈরি করেন অ্যালান এমটেজ। ইংরেজি শব্দ Archive থেকে Archie নামকরণ করা হয়। এছাড়াও অ্যালান ইনডেক্সিং ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান তার সার্চ ইঞ্জিনে, যা এখনকার সার্চ ইঞ্জিনেও তথ্য যোগ করার উপায় হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে আর্চি এখনকার সার্চ ইঞ্জিনের মতো কীওয়ার্ড ধরে ধরে খুঁজতে পারতো না, নির্দিষ্ট টাইটেল লিখে সার্চ না করলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যেত না। তারপরও বছর দুয়েকের মধ্যেই প্রায় ২.৬ মিলিয়ন ফাইল জমা হয়ে যায় বিশ্বের প্রথম সার্চ ইঞ্জিন আর্চিতে।
প্রায় একই সময়েই তৈরি হয় আরও দুটি সার্চ ইঞ্জিন 'ভেরোনিকা' এবং 'জাগহেড' নামের। ১৯৯৩ সালে তৈরি হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ওয়ানডেরার, যা ছিল এক্ষেত্রে প্রথম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ব্যবহারে তৈরি বট/রোবট যা নিজে থেকে লিংক সংগ্রহ করে ডেটাবেজে জমা করে রাখতে পারতো। কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগেই হারিয়ে যায়, তবে বট/রোবট সিস্টেম ব্যবহারের ধারণাটি থেকেই যায় যা আজকের সার্চ ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করে থাকে। এ সমস্যার সমাধান নিয়ে আসে ALIWEB, তবে সেটাও জনপ্রিয়তা অর্জন করে উঠতে পারেনি। জাম্পস্টেশন, WWW Worm, RBSE-ও যুক্ত হয় সার্চ ইঞ্জিন জগতে, আবার হারিয়েও যায় খুব দ্রুত।
এভাবেই চলতে সার্চ ইঞ্জিন তৈরির আর আপডেটের কাজ। চলতে চলতেই এক পর্যায়ে স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ৬ শিক্ষার্থীর হাত ধরে তৈরি হয় নতুন সার্চ ইঞ্জিন 'Excite', যেটি তাতে সংগ্রহ করে রাখা কন্টেন্টগুলোতে ব্যবহৃত শব্দগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে কন্টেন্টগুলোকে একটি র্যাংকিং সিস্টেমে এনে ফেলতে পারতো। নতুন এই ধারণা জনপ্রিয়তা দিয়েছিলো এক্সাইটকে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরি ইয়াং এবং ডেভিড ফিলো নামের দুই শিক্ষার্থী তৈরি করেন সারা জাগানো 'Jerry and David’s Guide to the World Wide Web' যা আজকের Yahoo। এটি শুরুতে শুধু খেলাধুলার তথ্য সংগ্রহ করতো। ধীরে ধীরে তারা ইয়াহুকে দাঁড়া করিয়ে ফেলেন আদর্শ এক সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে। তবে ভালোভাবে সেবা প্রদান করতে তাদের প্রয়োজন ছিল অর্থের। আর সেই অর্থ সংগ্রহ করা নিয়ে পড়তে হয়েছিলো বড়সড় এক বিড়ম্বনায়।
এখনকার সময়কার সার্চ ইঞ্জিনগুলো (গুগল, ইয়াহু, বিং, বাইজু ইত্যাদি) প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও সে সময়টায় একে মানুষ অনেকটা জনসেবা মনে করতো, এর বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা ন্যায্য কি না তা ছিল তখনকার সময়ের এবং সমাজের বিতর্কের অন্যতম বিষয়। এতো সব বিতর্ককে উপেক্ষা করে ইয়াহু নিয়ে নেয় সিদ্ধান্ত বিতর্কের মাঝেও বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে ফান্ড সংগ্রহ করে ইয়াহু। ইয়াহুর এই সময়েই Excite তাদের পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধান করে নতুন রূপে হাজির হয় মানুষের সামনে, চলতে থাকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।
আর এর মাঝেই ১৯৯৬ সালে আসে BackRub, যা হয়ে উঠেছে আজকের গুগল। ১৯৯৬ সালে সেই স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন তৈরি করে এটি, যাকে ১৯৯৮ সালে Google নামকরণ করা হয়। ধীরে ধীরে গুগল টপকে যায় ইয়াহু আর এক্সাইটকে।
বর্তমান পৃথিবীতে গুগল সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে কার্যকর সার্চ ইঞ্জিন। গুগল সার্চ ইঞ্জিনে ইন্ডেক্স করা প্রত্যেকটি কন্টেন্টকে ২০০ এরও বেশি ফ্যাকটর দ্বারা যাচাই করে সার্চ র্যাংকিং দেয়, যেখানে আবার প্রত্যেকটি লিংকে ইউজারের করা প্রত্যেকটি ক্লিককে গুগল হিসেব করে একেকটি ভোট হিসেবে, যা পরবর্তী সার্চে আবার র্যাংকে প্রভাব ফেলে। গুগলের অ্যালগরিদম পরিবর্তন করে বছরে পাঁচ শতাধিক বার। গুগল আছে বলেই আজ এত সহজে প্রায় যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি, আর গুগলের পূর্বের সার্চ ইঞ্জিনগুলো এসেছিল বলেই আজ আমরা গুগলকে পেয়েছি।
এরপর একে একে এসেছে আরও অনেক সার্চ ইঞ্জিনই। ২০০৯ সালে বিং নিয়ে হাজির হয় মাইক্রোসফট। মজার বিষয় হলো, বিং-এর সাথে মাইক্রোসফটের পাশাপাশি ইয়াহুও যুক্ত।
গুগল তার ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে। একে যারা সমস্যা মনে করতো তাদের জন্য বিং-এরও আগে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে হাজির হয় ডাক ডাক গো। চীনের বাইজু আর রাশিয়ার ইয়ানডেস্ক কিন্তু ইয়াহু, গুগলদের কাছাকাছি সময়েই এসেছে। ইয়ানডেস্ক ১৯৯৭ সালে আর বাইজু ২০০০ সালে। যদিও এরা বিশ্বব্যাপী সেবা দেয় না, দিতে আগ্রহীও না। নিজ দেশের মধ্যেই তাদের মূল সেবা। তাই গুগল ধরে রেখেছে তার নিজস্ব জায়গা। এখনকার সময়ে গুগলের সাথে পাল্লা দেয়া হয়তো অসম্ভবই।
আপনার জানা থাকার কথা, আমাদের বাংলাদেশেরও নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন আছে, পিপীলিকা, যা ১৩ এপ্রিল ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।