শার্ট, মানুষের
প্রতিদিনের পরিধেয় বস্ত্রের অন্যতম একটি। অনেক যুগ আগে থেকে এখনও পর্যন্ত শার্ট মানুষের
প্রিয় একটি পরিধেয় বস্ত্র। অফিসের জন্য নির্ধারিত ড্রেসকোডের অংশ হোক কিংবা হোক স্কুল
বা কলেজের ইউনিফর্ম, শার্ট আছে সব জায়গাতেই। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে কোনো
চাকরির ইন্টারভিউ, সব জায়গাতেই শার্ট। কিন্তু এই শার্টের বিবর্তন আমরা ক'জন জানি, শার্টের
ইতিহাস আমরা কতজনই বা জানি কিংবা কতজনইবা জানতে চেয়েছি? এতো বছরের প্রিয় শার্টটি প্রথম
কবে কোথায় তৈরি হয়েছে, শুরুতে শার্টের গঠন কেমন ছিলো এই প্রশ্নগুলো মনে কখনো জেগেছে?
অন্তত ছেলেদের আর মেয়েদের শার্টের বোতাম কেন ভিন্ন দিকে হয় সেই প্রশ্নের উত্তরই বা
জানার চেষ্টা করেছেন কখনো? হয়তো হ্যাঁ আবার হয়তো বা না। তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই
আজকের এই শার্টের ইতিহাস নামক আর্টিকেল।
ইতিহাসের পাতা
উল্টাতে থাকলে সবথেকে পুরোনো যে সময়টার সাথে শার্টের সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়েছে তা আনুমানিক
৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দেই প্রাচীন মিশরের লিনেন*১
কাপড়ের তৈরি শার্টটি এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া শার্টের মধ্যে সবথেকে পুরোনো। এখন এরকম
প্রশ্ন করতেই পারেন যে তখনকার সেই শার্টটি কি বর্তমান শার্টের মতো ছিলো বা আদৌ এখনকার
শার্টের সাথে সামান্য মিল পাওয়া যাবে?
বলতে গেলে গত
প্রায় অর্ধশতক যাবৎ শার্টের গঠনে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি একেবারেই। তবে
শুরু থেকে এই পর্যন্ত শার্ট বদলেছে বহুবার। শুরুর দিকে শার্টে যুক্ত ছিলো না কোনো কলার,
বহুবার পরিবর্তন এসেছে হাতাতেও। মজার বিষয় হচ্ছে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত এই শার্টকে কিন্তু
এখনকার মতো মূল ড্রেস হিসেবে পরিধানই করা হতো না, তখন হয় রাতে ঘুমানোর গাউন হিসেবে
পরা হতো কিংবা পুরুষের ক্ষেত্রে অন্য কোনো জামার নিচে আন্ডার গার্মেন্ট হিসেবে পরা
হতো শার্ট।
শার্টের পরিবর্তনের
ইতিহাসের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে শুধু হাতা আর কলার। শার্টের বিবর্তন ইতিহাস থেকে
জানা যায় ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো সময়ে পৃথকযোগ্য হাতা যুক্ত হয়
শার্টের সাথে। এই সময়কালে শার্ট ধীরে ধীরে শার্ট পরতে শুরু করেন নারীরাও ।
এই যে নারী
আর পুরুষের শার্টের বোতাম ভিন্ন দিকে হয়, বোতামের দিকের এই পার্থক্যটা শুরু হয় মূলত
ইউরোপীয় রেনেসাঁর পরপর। সে সময় যেসব নারীরা শার্ট পরিধান করতেন তারা মূলত নিজে নিজে
পরিধান করতেন না। তাদের কাজের লোক পরিয়ে দিতো এবং বোতামও লাগিয়ে দিতো। কোন ডানহাতি
কাজের লোকের জন্য সহজ হতো বিধায় তখন নারীদের শার্টের বোতাম বাম দিকে থাকতো। এবং পুরুষরা
যেহেতু নিজে নিজেই পরিধান করতো, তাই ডানহাতি কোন পুরুষের জন্য ডান দিকে বোতাম থাকা
সুবিধাজনক বিধায় পুরুষদের শার্টে ডানদিকে বোতাম রাখা হতো। তখন থেকে আজও পর্যন্ত পুরুষের
শার্টের বোতাম ডান পাশে এবং মেয়েদের বোতাম বাম পাশেই হয়ে আসছে, এর পরিবর্তন নিয়ে হয়তো
মানুষ ভাবেইনি।
যদি প্রশ্ন
করা হয় শার্টের কোন নির্দিষ্ট অংশটি সবথেকে বেশিবার পরিবর্তিত হয়েছে, তাহলে উত্তর হবে
কলার। শুরুরদিকে শার্টে কোনো কলার ছিলো না। এরপর পৃথকযোগ্য, লম্বা, হাই কলার আবার নিচু
এবং ফিক্সড কলার, এই কয়েকটি ধাপের পরিবর্তন চলেছে শতবছেরও বেশি সময় ধরে। পৃথকযোগ্য
হাতার মতো পৃথকযোগ্য কলার দিয়েই শার্টের কলারের শুরু বলে ধারণা করা হয়। ১৮২৭ সালে শার্টের
সাথে যুক্ত করা হয়েছিলো এই ধরণের কলার। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। সম্পূর্ণ শার্টের
থেকে কলার অংশটির গঠন অন্যরকম। সেসময় শার্ট পরিষ্কার করার কাজটা করতে ঝামেলা যাতে না
হয় তাই কলার আলাদা করে ধোয়া হতো। সবশেষ শতকের ৩০ এর দশকে ওয়াশিং মেশিন আসার পর ফিক্সড
কলারের প্রচলন শুরু হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শার্টের গঠনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন,
তার মধ্যে এটি অন্যতম একটি।
১০০ বছরেরও
বেশি সময়ের মধ্যে কলার বদলেছে অনেকবার। ১৮ শতকে লং নেক কলার ছিলো যা মাথার উপর পর্যন্ত
তুলে রাখা যেত। ১৮৪০ সালের আশে পাশে এক ব্রিটিশ অতিসৌখিন ব্যক্তি বোও ব্রুমেলকে দেখা
যায় গলা ঢেকে রাখা হাই কলারের শার্টে। লন্ডনের এক সড়কে তার একটি ভাস্কর্য তৈরি করে
নাম দেয়া হয়েছে মডার্ন স্ট্যাচু। ইচ্ছে হলে
এখনই তার নাম লিখে সার্চ করতে পারেন যেকোনো সার্চ ইঞ্জিনে, ছবি পেয়ে যাবেন। ১৯২০ এ
এসে আবার গোল গলার কলারের যায়গা দখল করতে থাকে পয়েন্টেড টাইপ কলার।
অতি দয়ালু মানুষ
সম্পর্কে ইংরেজিতে একটি প্রচলিত কথা আছে। প্রবাদটি হলো "To give the shirt
off one's back"। ঐতিহাসিকগণের মতে এই প্রবাদটির প্রচলন শুরু হয় ১৭৭১ সালে। শার্টের
বহু বিবর্তনের মধ্যে প্রথমদিকের আর দুটি বিবর্তনের একটা হলো ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির
মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে শার্টের ক্রপ টপ রূপ
পাওয়া আরেকটি অষ্টাদশ শতাব্দির শুরুর দিকে হওয়া টপ টেইলস এর ধরণটা।
প্রথম দিকেই
বলেছিলাম শার্টকে পরা হতো আন্ডার গার্মেন্টস হিসেবে, এতোদিনে কিন্তু তা বাদ পরে গেছে।
১৮ শতাব্দীর শুরুর দিকেই শার্টকে মূল বস্ত্র হিসেবে পরিধান করা শুরু হয়। আজও যেমন সাদা
শার্টকে অন্যতম ফরমাল ড্রেস বা আভিজাত্যের পোশাক হিসেবে ধরা হয়, তেমনটা ১৯ শতকেও ধরা
হতো। এই ধারণাটিও সেকাল থেকেই চলে আসছে নারী
পুরুষের শার্টের বোতামের ধারনার মতো করেই। ১৯ শতকে এসে শার্টকে মূলত স্পোর্টস শার্ট
আর লেবার শার্ট নামের দুটো আলাদা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়।
সাদা শার্টকে
আলাদা এক সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হলেও শার্টের সাথে রঙের সখ্যতা শুরু হয় ওই ১৯ শতকেই।
আজকের রঙ বেরঙের বাহারি সব ডিজাইনের শার্টের শুরুটা তখন থেকেই। আজ যেমন দর্জির থেকে
বানানো হয়ে থাকে প্রচুর শার্ট ফ্যাক্টরি বা গার্মেন্টসের বাইরেও, তখন মূলত এভাবেই কেনা
হতো। সাধারণ মানুষেরা অবশ্য বাড়িতে তৈরি শার্টই পরে থাকতো বেশিরভাগ সময়।
বলে নিয়েছিলাম
প্রাচীন মিশরে পাওয়া শার্টটি ছিলো লিলেন কাপড়ের। অনেক কাল ব্যাপি শুধু লিলেন আর রেশমের
কাপড় থেকেই তৈরি হতে থাকে শার্ট। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের জন্য তৈরি হতে
থাকে কৃত্রিম সুতার শার্ট। তখন মূলত ব্যবহার হতো রেনন, নাইলনের মতো রাসায়নিক কাপড়।
শার্টকে শুরুর
দিকে যেমন আন্ডার গার্মেন্ট হিসেবে পরিধান করা হতো, এখনও কিছুটা তেমনই হয়ে থাকে কোট
কিংবা ব্লেজারে নিচে। শার্টের সাথে শুরু হয় টাই এর ব্যবহার । হাফ হাতা, ফুল হাতা শার্টও
এই বিবর্তনের অংশ। শার্টে বড়সড় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ছিলো শার্টে পকেট যুক্ত করা। বুক
পকেটের শুরুটা ১৯৬০ সালে।
এই শার্ট সেই
সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ফ্যাশনের অন্যতম প্রধান উপাদান। আজকের রঙ বেরঙের বাহারি
সব কারুকার্যের শার্টের ইতিহাসটা এরকমই, বহু বছরের পুরোনো; বহু বছরের।
*১: লিনেন কাপড়
হচ্ছে Flax কাপড়ের অপর নাম যা ভেজিটেবল উৎসের বাস্ট ফাইবার ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত।
Tags:
Pathgriho_Desk