লিখেছেন সাঈদ আহমেদ ফয়সাল।
আপনিও লিখতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।
দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটা যে কিছুটা হাস্যকর তা নিয়ে হয়তো খুব একটা মতভেদ নেই। সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নিয়ম-কানুন প্রণেতাদেরও যে নেই তা জানা, তবে পুরো একটা শিক্ষাব্যবস্থাতো আর এক-দুই দিনে পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব না। সেদিকে আজ যাচ্ছি না।
এই শিক্ষাব্যবস্থাকে হাস্যকর বলার অনেকগুলো কারণ রয়েছে, তারমাঝে অন্যতম একটা হলো লিখিত পরিক্ষার খাতায় নম্বর দেওয়ার সিস্টেম (খাতা মার্কিং)। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই লিখিত পরিক্ষার বিরোধিতা করি। কারণ আমি মনে করি আমাদের শিক্ষানীতি অনুসারে লিখিত পরিক্ষা মানেই শিক্ষা, মেধা, মনন-কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা; তা যতই সৃজনশীল পদ্ধতিতে হোক না কেন।
প্রথমেই আসি মাতৃভাষা বাংলার দিকে। বাংলা এমন একটা বিষয় যেখানে একটি সৃজনশীল প্রশ্নের ক, খ, গ এবং ঘ অর্থাৎ জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ এবং উচ্চতর দক্ষতার উত্তর লিখতে কতোটা কষ্ট হয় এবং কেমন সময় প্রয়োজন হয় তা একমাত্র ওই পরিক্ষার্থীরাই বুঝে থাকে। তবুও হাতের লিখা অতি উত্তম, প্রশ্নের সর্বোৎকৃষ্ট উত্তর লিখলেও সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া যাবে ৮ কিংবা ৯। অনেক পরীক্ষকেরাই (কখনোই সবাই না) ক, খ, গ এবং ঘ এর উত্তরে মুখস্তভাবে মার্কিং করে যান ১,২,২ এবং ৩ করে মোট ৮।
এবার আসা যাক ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানার জন্য পড়া বাংলা ২য় পত্রের দিকে। ব্যকরণ অংশ নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। এসএসসিতে বহুনির্বচনী এবং এইসএসসিতে লিখিত হলেও সেখানে সঠিক উত্তরে পূর্ণ নম্বর পাওয়া যায়। কিন্তু নির্মিতি অংশে? এই অংশের প্রতিবেদন, ভাব-সম্প্রসারণ, ভাষণ, ক্ষুদে গল্প, প্রবন্ধ এসব প্রশ্নের উত্তর যদি স্বয়ং ড.হায়াৎ মামুদ স্যার কিংবা দেশের কোন ভাষাবিজ্ঞানী নিজেও লিখেন এবং দৈবচয়ন করে যেকোনো, হ্যাঁ দেশের যেকোনো স্কুল বা কলেজের যেকোনো বাংলা শিক্ষককে দিয়ে মার্কিং করানো হয়, তখন উনারও ৮ এর মাঝে সর্বোচ্চ ৬, ১০ এর মাঝে সর্বোচ্চ ৮ কিংবা ৯, ২০ এর মাঝে সর্বোচ্চ ১৬-১৭ পাওয়ার খুব বড় একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। সারাদেশে একজন বাংলা শিক্ষকও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা যিনি ড.হায়াৎ মামুদ স্যারকে পরিচয় না জেনে ১০ এ ১০ আর ২০ এ ২০ দিবেন। এটাই সত্য।
ইংরেজির বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা, দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি গ্রামার বই লিখেছেন যে চৌধুরি এবং হোসাইন স্যারেরা, তারা নিজেরাও যদি Story, Report, Application, Paragraph, Composition এর মতো রাইটিং অংশের উত্তর লিখেন এবং যেকোনো শিক্ষককে মার্কিং করার দায়িত্ব দেয়া হয়, সারাদেশে হয়তো এমন একজন শিক্ষকও পাওয়া যাবেনা যিনি ইনাদের পরিচয় না জেনে ইনাদেরকে ফুল মার্কস দিবেন। এমনকি, যেকোনো একটি কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট এর হেড যিনি, উনিও যদি এই টপিক গুলোর লিখিত পরিক্ষা দেন এবং তাঁরই অধীনস্ত সহকারী শিক্ষকদেরকে দিয়ে নম্বর দেওয়ানো হয়, উনারও ফুল মার্ক পাবার সম্ভাবনা শূন্যের ঘরেই থাকবে।
আপনি কখনও কোনো শিক্ষক-কে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না যে এতো সুন্দর করে, সর্বোৎকৃষ্টভাবে লিখলাম, তবুও নম্বর ১০ এর মাঝে ৯ কেন? ১০ তবে কার জন্য? দেশের প্রতিটা শিক্ষকই এর প্রত্যুত্তরে বলবেন, "বাবা, ১০ এর মাঝে ৮ই অনেক, ৯ এর বেশি দেয়া যায় না।" কিন্তু কেন দেওয়া যায়না, তার উত্তর সম্ভবত স্বয়ং শিক্ষা বোর্ডের প্রধান কর্মকর্তাদের কাছেও নেই। অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে এটি এখন। ১০ এর মাঝে যদি সর্বোচ্চ ৮ বা ৯- এর বেশি দেওয়া না-ই যায়, তাহলে মার্ক এর প্যাটার্নে ১০ এর লোগোটা কেন লাগানো? কেটে ৮/৯ করে দিন। ১০ এর মান সর্বোচ্চ ৮/৯ হোক। নাকি তখন বলা হবে “৯ এর মাঝে ৮ সর্বোচ্চ, ৯ দেয়া যায় না”?
এরূপ কর্মকান্ড করে শুধু শুধু শিক্ষানীতিটাকে সকলের কাছে হাস্যকর করা হচ্ছে না তো? হাস্যকর কিংবা আফসোস, যেভাবেই গ্রহণ করুন না কেন - এটাই সত্য। এটাই বাস্তব।
আরেকটা বিষয় হলো, ইংরেজিতেই Composition এর বেলায় প্রশ্নপত্রে বলা থাকে
"Write within at least 200 words but do not exceed 250 words”
বা এরকম ভাবেই কোন না কোন ওয়ার্ড লিমিটের শর্ত। এই ২৫০ টি শব্দ দিয়ে Composition লিখতে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন পৃষ্ঠা লাগবে। তাহলে নম্বর ১৪ এর মাঝে কত পাওয়া যাবে.? ৫ নম্বরও হয়তো দিবেননা, দয়া মায়া হলে কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে দিবেন হয়তো। এর বেশি ভুলেও না। স্বয়ং চৌধুরী স্যারের বই থেকে হুবহু কপি পেস্ট করে লিখলেও দেখা যাবে ৪ পৃষ্ঠার বেশি হবেনা, যদিও এটি প্রশ্নপত্রের কন্ডিশন অতিক্রম করছে, কিন্তু সারাদেশের কোনো শিক্ষক এতটুকু লেখায় সন্তুষ্ট না হয়তো। আরেকটু চাই। তাহলে প্রশ্নপত্রে সর্বোচ্চ ২৫০ শব্দের কন্ডিশন টা দেওয়ার কি দরকার ছিল? শুধু শুধু ২৫০ শব্দের কন্ডিশন দিয়ে আরও একবার নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে আফসোস করার কারণ দিয়ে দিলেন তারা।
লিখেছেন: সাঈদ আহমেদ ফয়সাল।
এসএসসি ২০১৭- পঞ্চমীঘাট স্কুল এন্ড কলেজ, নারায়ণগঞ্জ।
এইচএসসি ২০১৯- ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, ঢাকা।
বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
Tags:
Guest_Writings